বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
বড় ক্লাবে আমার প্রথম মরশুম ছিল স্বপ্নের মতো। ইস্ট বেঙ্গলের মাঝমাঠে তখন দাপট দেখাচ্ছে পিন্টু চৌধুরি ও মোহন সিং। তা সত্ত্বেও দলবদলের আগে ফুটবল সচিব অজয় শ্রীমানি যোগাযোগ করেছিলেন আমার সঙ্গে। অচ্যুৎ ব্যানার্জির আশীর্বাদ নিয়ে ইস্ট বেঙ্গলে সই করি। এর আগে জুনিয়র বাংলা দলের হয়ে খেলার সময় সুধীর-পিন্টুর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। লাল-হলুদে ওরাই আমায় স্বাগত জানায়। কোচ পিকে ব্যানার্জিও আমায় চিনতেন। ১৯৬৭’তে রাজস্থানের হয়ে ওঁর বিরুদ্ধে খেলেছিলাম। প্রদীপদাকে থামতে বেশ কয়েকবার কড়া ট্যাকলও করতে হয়েছিল। ম্যাচের পর উনি বলেছিলেন, ‘ছোকরার তো বেশ সাহস আছে।’ হয়তো সেই সাহসের জন্যই ইস্ট বেঙ্গলের জার্সি গায়ে তুলতে অসুবিধা হয়নি। লিগের দ্বিতীয় ম্যাচে মোহন সিং আসতে দেরি করায় প্রদীপদা ও শ্রীমানিদা আমায় মাঠে নামতে বলেন। কুমারটুলি ম্যাচের পর আর পিছনে তাকাতে হয়নি আমায়। চতুর্থ ম্যাচে মহমেডান স্পোর্টিংকে দু’গোলে হারালাম। স্কোরশিটে আকবরে পাশে আমারও নাম ছিল। দূরপাল্লার শটে সেই লক্ষ্যভেদ আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছিল অনেকটাই। পেয়েছিলাম সমর্থকদের আস্থাও। সেই সময় লেফট উইঙ্গারের ভূমিকায় লতিফুদ্দিনের মানিয়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছিল। তাই লিগের ষষ্ঠ ম্যাচ থেকেই পিন্টুদাকে (সমরেশ চৌধুরি) ওই পজিশনে ব্যবহার করেন প্রদীপদা। ওটাই ওঁর মাস্টার স্ট্রোক। ত্রিমুকুট জয়ের রসায়ন। ত্রিমুকুট ছাড়াও পেয়েছিলাম কলকাতা লিগ ও বরদলুই ট্রফি। অর্থাৎ পাঁচে পাঁচ।
সেবার ইস্ট বেঙ্গল দল ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। এছাড়া আমরা একে অপরের শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলাম। আক্রমণে ঝড় তুলত স্বপন সেনগুপ্ত, হাবিব, আকবর ও পার্টনার (পিন্টুকে আমি এখনও এই নামেই ডাকি)। মাঝমাঠে সৃজনশীলতার দায়িত্ব নিত মোহন সিং। আমার কাজ ছিল, ডিফেন্ডারদের সহযোগিতা করা। সুধীর-সি প্রসাদদের সামনে দাঁড়িয়ে ব্লকিংয়ের পাশাপাশি আক্রমণ শুরুর দায়িত্বও ছিল আমার কাঁধে। লিগে অরুণ ঘোষের মোহন বাগানকে ২-০ গোলে হারিয়েছিলাম। গোল পেয়েছিল স্বপন ও হাবিব। ডুরান্ডে মোহন বাগান সত্যিই দারুণ খেলেছিল। ফাইনাল গোলশূন্য থাকায় রিপ্লে হল। হাবিবের পেনাল্টি গোলে মোহন বাগানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলাম। ত্রিমুকুটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দলকে রোভার্সের প্রতি ম্যাচে উজ্জীবিত করতে গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ার কাছে শেলি হোটেলে নিয়মিত আসতেন শচীন কর্তা। প্রদীপদার সঙ্গে তাঁর সে কী গল্প! সেমি-ফাইনালে ওঠার পর শচীন কর্তা একদিন আমাদের নিয়ে স্টুডিও পাড়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন। গান রেকর্ডিং কীভাবে হয় তা সেদিনই প্রথম দেখেছিলাম। উনি মনপ্রাণে চেয়েছিলেন রোভার্স ফাইনালে আমরা মোহন বাগানকে হারাই। কিন্তু তরুণ বসু-সুকল্যাণ ঘোষ দস্তিদারদের জন্য ফাইনালের মতো রিপ্লেও গোলশূন্য ড্র হয়। যুগ্মজয়ী হলেও ত্রিমুকুট পেয়েছিলাম। তবে তা হয়তো ২৪ ক্যারটের ছিল না।
শিল্ড ফাইনালে মোহন বাগান ওয়াকওভার দিয়েছিল। ফাইনালে সুকল্যাণ ঘোষদস্তিদারের গোলে মোহন বাগান এগিয়ে থাকার সময়ে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়। একবার তো তরুণ বসুকে পরাস্ত করে হাবিবের শট জলে আটকে গিয়েছিল। বরদলুই ট্রফিতে খেলতে যাওয়ার কথা থাকায় পুজোর পর রিপ্লে দেয় আইএফএ। এই নিয়ে প্রবল আপত্তি ছিল ধীরেন দে’র। শেষ পর্যন্ত রিপ্লে ম্যাচে দলই নামায়নি মোহন বাগান। আমরা কিন্তু মাঠে মোহন বাগানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন শিল্ডে চ্যাম্পিয়ন হতে চেয়েছিলাম! লিগে ২১টি ম্যাচে গোল না খাওয়ায় আমাদের মনোবল ছিল তুঙ্গে। প্রদীপদার প্রি-সিজন ট্রেনিং ছিল আমাদের সাফল্যের অন্যতম কারণ। ইস্ট বেঙ্গল মাঠে ১০ পাক চক্কর দেওয়ার পর নিজেই ফুটবলারদের পালস রেট নোট করতেন। এই রেট বেশি থাকা খেলোয়াড়দের জন্য বরাদ্দ থাকত অন্যরকম ট্রেনিং। অনেকদিনই ফোর্ট উইলিয়ামের পাশ দিয়ে শর্টকাটে নিয়ে যেতেন পার্ক স্ট্রিট মোড়ে। ট্রামের সঙ্গে ছোটাতেন এসপ্ল্যানেড গুমটি পর্যন্ত। তাই পাঁচ-পাঁচটি ট্রফিতে খেললেও আমরা মরশুমের শেষ দিন পর্যন্ত দৌড়েছি। লোকে বলে, প্রদীপদার সাফল্য ভোকাল টনিক নির্ভর। এটা সম্পূর্ণ ভুল। কথার মায়াজালের মাধ্যমে ফুটবলারদের পরিশ্রম করিয়ে নিতে পারাটাই ওঁর ইউএসপি। ত্রিমুকুট জয়ের নেপথ্যে অবদান রয়েছে ফুটবল সচিব অজয় শ্রীমানিরও। ফুটবলারদের সুখদুঃখে পাশে দাঁড়ানো ছিল ওঁর নেশা। ত্রিমুকুট জয়ের পর সুধীর, হাবিবের পাশাপাশি আমাকেও উনি হিরের আংটি দিয়েছিলেন।