প্রীতম সিনহা  কলকাতা: ময়দানের জরাজীর্ণ এক টেন্ট। চৌহদ্দির ভাঙাচোরা বেড়ার ওপারে পাশাপাশি দুটি চেয়ারে দুই হুজুর। দেখে সায়ক গোষ্ঠী পরিচালিত ‘দুই হুজুরের গপ্পো’ নাটকের কথা আপনার স্মৃতিকে উসকে দিতে পারে। ওঁরা দুই প্রধানের সত্তরোর্ধ্ব দুই কট্টর সমর্থক। গাছের ফাঁক দিয়ে শীতের পড়ন্ত বিকেলের টুকরো টুকরো রোদ গায়ে মেখে মেতে উঠলেন আড্ডায়, চলল খুনসুটিও। আর সেই স্মৃতিমেদুরতার ব্যাপ্তি বুড়ো বটের শিকড়ের মতোই গভীর। কথার পরতে পরতে খসে পড়ল জীবনভর গড়ে তোলা স্বপ্নের ফুটবল প্রাসাদের পলেস্তরা।

হুজুর এক: শ্যামল সেনগুপ্ত। বয়স ৭৫। বাড়ি নেতাজিনগর। সেই ন’বছর বয়স থেকেই কাঁধে সবুজ-মেরুন পতাকা। মোহন বাগান তাঁর বেঁচে থাকার রসদ। অকৃতদার এই মানুষটি অশক্ত শরীর নিয়েও রোজ সকালে পৌঁছে যান ময়দান চত্বরে। বারো মাস। এমন অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরা শ্যামলবাবুর ঘোলাটে চোখে বিষাদের ছবি স্পষ্ট। প্রিয় দলের খেলা দেখে আর মন ভরে না যে! তবু কোনও এক দুর্নিবার আকর্ষণ আজও তাঁকে নিয়মিত মাঠে টেনে আনে। বলছিলেন, ‘জার্নেল সিং, আমেদ খান, সুকুমার সমাজপতি, চুনি গোস্বামী, বলরামের খেলা দেখেছি। ওদের টানেই মাঠে আসা শুরু। সেই মান আজ সময়ের সঙ্গেসঙ্গে ইতিহাস। কিন্তু আবেগ তো আর জলাঞ্জলি দিতে পারি না।’ একটু থেমে যোগ করলেন, ‘একটা সময় বড় ম্যাচ এলে উৎসবের রোমাঞ্চ অনুভব করতাম। রাতে ঘুম আসত না। মনে আছে, আমি তখনও চাকরি করি। অফিসে কাজের চাপ থাকায় ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাফ জানিয়ে দিলেন, ডার্বি দেখতে যাওয়ার জন্য ছুটি দেওয়া যাবে না। অমনি আমিও চাকরি ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিলাম। ব্যাস, ছুটি মঞ্জুর। এখন নানা কারণে প্রতি ডার্বিতে মাঠে যাওয়া হয় না। তবে রবিবার যুভারতীতে যাব।’
হুজুর দুই: রমেন দে। বয়স ৭২। বাড়ি বরানগর। পেশা ব্যবসা হলেও ফুটবল নিয়েই মেতে রয়েছেন দশকের পর দশক। কট্টর ইস্ট বেঙ্গল সমর্থক। সঙ্গে রয়েছে পাড়া ফুটবলে টিম নামানোর নেশা। বছর দেড়েক আগে হাঁটুর অস্ত্রোপচার সত্ত্বেও দমে যাননি তিনি। আবেগের ঝুলি হাতড়ে রমেনবাবু বলছিলেন, ‘মামার হাত ধরে প্রথমবার বড় ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম। তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। সেই স্বাদ এখনও উপভোগ করছি। ইস্ট বেঙ্গলের জন্য গলা ফাটাতে না পারলে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। অরুণ ঘোষ, প্রশান্ত সিনহা, কাজল মুখার্জি, মজিদ বাসকর, মনোরঞ্জনদের খেলা আনন্দ দিত। এখন সেই ঝাঁঝ কোথায়?’
হতাশা বুকে চেপে তবু বড় ম্যাচ দেখতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন রমেনবাবু। কে জিতবে বলে মনে হয়? তাঁর জবাব, ‘দুই দলের মধ্যে ফারাক খুবই কম। আর সেটাই ইস্ট বেঙ্গল সম্পর্কে কিছুটা আশা জোগাচ্ছে।’ অমনি জোরালো প্রতিবাদে গর্জে উঠলেন শ্যামলবাবু। চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বললেন, ‘এতো সোজা নয়। মিলিয়ে নেবেন মোহন বাগানই জিতবে।’ বোঝা গেল, কলকাতা ময়দানের ঐতিহ্যের ডার্বির রং চটলেও দুই হুজুরের ঝগড়ার আঁচটা আগের মতোই থেকে গিয়েছে।