বিদ্যায় অধিক পরিশ্রম করতে হবে। ব্যবসায় যুক্ত ব্যক্তির পক্ষে দিনটি শুভ। প্রেম-প্রীতিতে আগ্রহ বাড়বে। নতুন ... বিশদ
রাতুল ঘোষ : বয়স তাঁর কাছে নিছকই একটা সংখ্যা মাত্র। প্রতিপক্ষ কোন দল, কি টুর্নামেন্ট— এসব তিনি আদৌ ধর্তব্যের মধ্যে আনেন না। মাঠে পা রাখা মাত্র তিনি এক অন্যগ্রহের মানুষ। যিনি কঠিনতম চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসেন, পরাজয়কে হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে ঘৃণা করেন। ফুটবল দুনিয়ায় সি আর সেভেন বা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো একজনই আছেন। মঙ্গলবার তুরিনের অ্যালায়েঞ্জ স্টেডিয়ামে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের রাউন্ড অব সিক্সটিনে দ্বিতীয় পর্বের ম্যাচে নিজেকে এক অভ্রংলিহ উচ্চতায় তুলে নিয়ে গেলেন রোনাল্ডো। একাই হ্যাটট্রিক করে দু’গোলে লিড নেওয়া প্রতিপক্ষ আতলেতিকো মাদ্রিদকে ধ্বংস করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে ‘ছুটি’ করে দিলেন। তাদের আর ওয়ান্ডা মেট্রোপলিটানোয় এবার ফাইনালে খেলার স্বপ্ন পূর্ণ হল না। এটি রোনাল্ডো’র অষ্টম হ্যাটট্রিক (লিও মেসিরও এই রেকর্ড রয়েছে)। ফুটবল কেরিয়ারে এটি তাঁর ৫২তম হ্যাটট্রিক। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রোনাল্ডো এখন ১২৪টি গোলের মালিক। এই টুর্নামেন্টে মেসির মোট গোল ১০৬টি।
মঙ্গলবার অ্যালায়েঞ্জ স্টেডিয়ামে আক্ষরিক অর্থেই এক মায়াবি রাত উপহার দিলেন রোনাল্ডো। ব্যর্থতার কানাগলি থেকে সাফল্যের রাজপথে জুভেন্তাসকে ফিরিয়ে আনতে গোটা দলকে উদ্বুদ্ধ করলেন এবং সতীর্থদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন।
প্রথম পর্বে ঘরের মাঠ ওয়ান্ডা মেট্রোপলিটানোয় আতলেতিকো মাদ্রিদ প্রথম পর্বের ম্যাচে শেষ পাঁচ মিনিটে দুটি গোল করে লিড নিয়েছিল। তাদের দুই ডিপ ডিফেন্ডার হোসে জিমিনেজ ও ডিয়েগো গডিন হেডে লক্ষ্যভেদ করে আতলেতিকোকে এগিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও ওই ম্যাচে আলভারো মোরাতার একটি গোল ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির সাহায্য নিয়ে বাতিল করা হয়। এবং একটি ক্ষেত্রে বিতর্কিত পেনাল্টির দাবিও অগ্রাহ্য হয়েছিল। এমনিতে আতলেতিকো মাদ্রিদের রক্ষণ গত পাঁচ বছরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সবচেয়ে কম গোল হজম করেছে। প্রথম পর্বের ম্যাচে রোনাল্ডো এই ডিফেন্সকে ভাঙতে পারেননি। কিন্তু গত মঙ্গলবার রাতে তিনি এই সুদৃঢ় রক্ষণ ভাঙতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। আর সেই লক্ষ্যে গত কয়েক সপ্তাহ শূন্যে উড়ে আসা বলে হেডিং অনুশীলনে বিশেষ নজর দেন। তাঁর মতো দুরন্ত স্পটজাম্প এখন বিশ্বের খুব কম স্ট্রাইকারেরই রয়েছে। অথচ সি আর সেভেনের বয়স এখন ৩৪ বছর।
৪-৩-৩ ফর্মেশনে দল সাজায় জুভেন্তাস। অন্যদিকে আতলেতিকো মাদ্রিদের ছক ছিল ৪-৪-২। জুভেন্তাসের কোচ ম্যাসিমিলিয়ানো অ্যালেগ্রি দুই উইং ব্যাক জোয়াও ক্যানসেলো এবং লিওনার্দো স্পিনাজোলাকে ম্যাচের শুরু থেকেই ঘন ঘন ওভারল্যাপে ওঠার নির্দেশ দেন। তাই শুরু থেকেই দেখা যায় এই দুই উইং ব্যাক দু’প্রান্তে ঝড় তুলে একের পর এক ক্রস সেন্টার তুলছেন আতলেতিকো পেনাল্টি বক্সে। কিন্তু আতলেতিকোর দুই সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হোসে জিমিনেজ ও ডিয়েগো গডিন অধিকাংশ এরিয়াল বলই হেডে ক্লিয়ার করে দিচ্ছিলেন। শুরু থেকেই ঝড়ের গতিতে আক্রমণে ঝাঁপায় জুভেন্তাস। পাঁচ মিনিটে তাঁদের একটি গোল ফাউলের জন্য বাতিল হয়। এই আক্রমণ থেকে গোলমুখে জান ওবলাকের হাতে আসা বল ছিনিয়ে নিয়ে ট্যাপ করেন রোনাল্ডো। ছিটকে আসা বল পিছন থেকে ছুটে এসে গোলে পাঠান চেলিনি। কিন্তু রেফারি কুইপার্স ভিডিও প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে গোলটি বাতিল করেন ওবলাককে ফাউল করার জন্য। যা কুপিত করে জুভেন্তাসের ফুটবলারদের। এর পরেও অলআউট আক্রমণ জারি রাখে জুভেন্তাস। প্রথম পনেরো মিনিট তাদের বল পজেশন ছিল ৭১ শতাংশ। এই পর্বে আতলেতিকো ১০ জনকে নামিয়ে আনে রক্ষণে। কিন্তু এইভাবে বেশিক্ষণ দেওয়ালে পিঠ দিয়ে লড়া যায় না। এই পর্বে প্রতি আক্রমণে অনীহা দেখিয়েছে আতলেতিকো। গোটা ম্যাচে তারা জুভেন্তাসের গোল লক্ষ্য করে একটিও শট রাখতে পারেনি। পায়নি একটা কর্নারও।
২৭ মিনিটে রোনাল্ডোর প্রথম গোল। যা ম্যাচে ঘুরে দাঁড়াতে জুভেন্তাসকে অক্সিজেন জোগায়। মুভটা শুরু হয়েছিল নিজেদের হাফলাইনে আলভারো মোরাতার পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে এমরে ক্যানের তোলা লম্বা লব থেকে। বাঁ-দিক থেকে ততক্ষণে পেনাল্টি বক্সের মাথায় চলে আসার ফাঁকে বার্নাডেসচি লক্ষ্য করেন, দ্বিতীয় পোস্টের দিকে দৌড় শুরু করে দিয়েছেন রোনাল্ডো। গডিন ও জিমিনেজকে টপকে শূন্যে বল দখলের লড়াইয়ে জয়ী রোনাল্ডো নির্ভুল হেডে ওবলাককে পরাস্ত করেন (১-০)। ৩১ মিনিটে বার্নাডেসচির ফ্রি-কিক অল্পের জন্য ক্রসবারের উপর দিয়ে উড়ে যায়। ৪ মিনিট বাদে তার একটি দুরন্ত বাইসাইকেল কিক পোস্টের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এছাড়া চেলিনির একটি হেড অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
বিরতির পর মাঠে আসার পথে রোনাল্ডো তার সতীর্থদের পুনরায় পিঠ চাপড়ে ঝাঁপানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। ৪৯ মিনিটেই পুনরায় রোনাল্ডোর দুরন্ত হেডে দ্বিতীয় গোলটি পায় জুভেন্তাস। ডানদিক থেকে রাইটব্যাক জোয়াও ক্যানসেলো দ্বিতীয় পোস্টে ক্রসসেন্টার ভাসিয়ে দেন। পুনরায় দুই ডিফেন্ডারকে টপকে রোনাল্ডোর হেড গোলে ঢোকার পর তা চাপড়ে বের করে দেন ওবলাক। কিন্তু গোললাইন প্রযুক্তির সাহায্যে দেখা যায় ওটি ক্লিয়ার গোল (২-০)। ৬৭ মিনিটে স্পিনাজোলাকে তুলে নিয়ে জুভেন্তাস কোচ অ্যালেগ্রি মাঠে নামান পাওলো ডায়বালাকে। এর ফলে বাঁ-দিকের আক্রমণ কিঞ্চিৎ ব্যাহত হয়। অতঃপর ৮০ মিনিটে আপাত ব্যর্থ মারিও মান্ডুকিচকে তুলে নিয়ে ১৯ বছরের প্রতিভা মইশ কিনকে মাঠে নামানো হয়। আর প্রথম টাচেই দুরন্ত গতির সাহায্যে আতলেতিকো ডিফেন্স ভেঙে প্রায় গোল করে বসেছিলেন কিন। তার পুশ আগুয়ান ওবলাকের হাতের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
দু’দফার ম্যাচে গোলের এগ্রিগেট যখন ২-২ তখনই বার্নাডেসচি দুরন্ত গতিতে একের পর এক আতলেতিকো ডিফেন্ডারকে অতিক্রম করে বক্সে ঢুকে পড়ার পর পরিবর্ত অ্যাঞ্জেল কোরিয়া তাঁকে পিছন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেন। রেফারি ভিডিও প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে পেনাল্টির নির্দেশ দেন। বল হাতে তুলে নিয়ে পেনাল্টি স্পটে বসান রোনাল্ডো। তারপর ডান পায়ের ইনস্টেপে নেওয়া নিচু শটে আতলেতিকো গোলরক্ষক জান ওবলাককে উলটো দিকে ফেলে হ্যাটট্রিক সম্পন্ন করেন সিআর সেভেন (৩-০)। তখন ভিআইপি গ্যালারিতে উপবিষ্ট রোনাল্ডোর বান্ধবী জিওর্জিনা রডরিগেজের দু’চোখে বইছে আনন্দাশ্রু। জুভেন্তাসের মালিক অ্যাগনেলি বুকে জড়িয়ে ধরেছেন স্পোর্টিং ডিরেক্টর পাভেল নেডভেডকে। তাঁরা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছেন ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড গুণে রোনাল্ডোকে খরিদ করার সিদ্ধান্ত কতখানি নির্ভুল ছিল। তিনি বিগ ম্যাচ প্লেয়ার। তাই গত ছ’টি ম্যাচে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে মাত্র ১ গোল পেলেও তা নিয়ে রোনাল্ডোর কোনও মাথাব্যথা ছিল না।