নিজস্ব প্রতিনিধি, কুলটি: একসময় তরতাজা ঘোড়ার কদর ছিল। এখন সেই ঘোড়াই পশ্চিম বর্ধমানে জিটি রোডের উপর অনাদরে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে। কখনও আবার খাবারের সন্ধানে বাজারহাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গোরু, ছাগল, ষাঁড়ের মতোই কুলটির রাস্তাঘাটে আকছার দেখা মিলছে সাড়ে পাঁচ ছ’ ফুটের বড় ঘোড়ার। কুলটিতে কদর নেই ওদের। কারণ অবলুপ্তির পথে কুলটির ঐতিহ্যবাহী টাঙা। অটো, টোটোর দাপটে টাঙা চালকদের রোজগার একেবারেই কমে এসেছে। কয়েক বছর আগেই যেখানে ৭০টি ঘোড়ার গাড়ি ছিল, এখন তা কমে ৩০টিতে ঠেকেছে। গাড়ি না চললে ঘোড়া দিয়ে কী হবে? তাই বাজারে সুস্থ সবল ঘোড়াগুলিকে ছেড়ে দিচ্ছেন মালিকরা। একদা অন্ন জোগানো এই প্রাণীগুলির খাবার জোগানোর ক্ষমতা নেই টাঙা চালকদের। তাই তাঁদের দাবি, টাঙা বাঁচাতে উদ্যোগ নিক সরকার। বিপন্ন প্রাণীগুলির করুণ অবস্থা দেখে প্রশাসনিক পদক্ষেপের আশায় রয়েছেন পশুপ্রেমীরাও। আরটিও পুলিনরঞ্জন মুন্সি বলেন, চালকরা আবেদন করলে বিষয়টি গুরুত্ব দিগে খতিয়ে দেখব। ‘কোয়ি হাসিনা জব রুট জাতি হ্যা তো, অর ভি হাসিন হো জাতি হ্যায়’, শোলে সিনেমার এই বিখ্যাত গানের দৃশ্যে টাঙায় চেপে ধর্মেন্দ্র ও হেমামালিনীর ‘রোম্যান্স’ আজও চলচ্চিত্র প্রেমীদের নাড়া দেয়। শুধু শোলে নয়, একাধিক হিন্দি বাংলা সিনেমায় টাঙা গাড়ির অস্তিত্ব রয়েছে। তবে কুলটিতে টাঙা গাড়ির আলাদা মর্যাদা ছিল। ইস্কোকে কেন্দ্র করে কুলটির জনপদ বেড়ে ওঠে। সেই সময় এই এলাকার যোগাযোগের মাধ্যম ছিল এই টাঙাই। সেই সময় ঘোড়ার গাড়িতে চেপে ঘুরতে যাওয়া ছিল ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে যানবাহনেরও পরিবর্তন হয়েছে। বহু বছর ধরেই রাজ্যে সেভাবে আর নজরে পড়ে না টাঙা বা ঘোড়ায় টানা গাড়ি। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল কুলটি। আখতার হোসেন, মহম্মদ ইসমাইলরা বাপ ঠাকুরদার পেশাকে ধরে রেখেছিলেন। তাই কুলটি স্টেশনে কেউ নামলেই সেই যাত্রী পেয়ে যেতেন ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়ার গাড়িই তাঁকে নিজ গন্তব্যে পৌঁছে দিত। একইভাবে কুলটি বাসস্ট্যান্ডে নেমে থানা মোড় থেকে মানুষ টাঙায় কখনও স্টেশন, কখনও বাজারে যেতেন। কয়েক বছর আগেও ভালো ছিল ঘোড়া, স্বচ্ছল ছিলেন টাঙা চালকরা। অনেকে আবার সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে ঘুরতে বের হতেন। কিন্তু অবস্থার বদল হতে থাকে বছর দুই আগে থেকে। কুলটিতে বাড়তে থাকে অটো ও টোটোর দাপট। ক্রমেই নিজেদের জায়গা হারাতে থাকে টাঙা। ঘোড়ায় টানা টাঙা বাসের কাছে নিয়ে যাওয়া যায় না। নির্দিষ্ট জায়গায় থাকতে হয়। অথচ টোটো, অটো চালকরা বাস থেকে নামা মাত্রই যাত্রীদের নিজেদের গাড়িতে তুলে নিচ্ছেন। তাই যাত্রী তোলার সুযোগই পাচ্ছেন না টাঙা চালকরা। খুব শখ করে কেউ যদি ঘোড়ার গাড়িতে চাপতে চান, তবে তিনি আসেন। এভাবে রোজগার প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। তাই বহু প্রজন্মের পেশা অনেকেই বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন। এতেই চরম বিপাকে পড়ছে ঘোড়াগুলি। মনিবকে এতদিন সেবা করলেও এমন আর্থিক অবস্থা যে, তাকে খাওয়ানোর টাকা নেই। আগে মনিবরা দিনে ১৫০ টাকার ছোলা ও অন্যান্য সামগ্রী খাওয়াতেন মনিবরা। কিন্তু এখন সারাদিনে ওই টাকা রোজগারই হয় না তাঁদের। বাধ্য হয়ে পেটের টানে ঘোড়াগুলি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। টগবগ করে ছোটা তেজি ঘোড়াই এখন মাথা নামিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে।
ঘোড়ার গাড়ির চালকদের দাবি, থানা মোড় থেকে স্টেশন এই রুটটি শুধু আমাদের জন্য দেওয়া হোক। প্রশাসন নিশ্চিত করুক এই রুটে যেন কোনও অটো বা টোটো না চলে। তাহলেই আমাদের অবস্থা ফিরবে।