বিএনএ, বাঁকুড়া: মুড়ির সঙ্গে বাঁকুড়ার প্রেম চিরন্তন। বাঁকুড়াবাসীর মুড়ি-প্রীতির কথা তাই লোকের মুখে মুখে ফেরে। তাই ফি বছর ৪ মাঘ বাঁকুড়া কেঞ্জাকুড়ায় কোথাও খবরের কাগজ পেতে, কোথাও থালা সাজিয়ে মুড়ি মেলায় হাজির হন জেলার পাশাপাশি আশেপাশের বেশ কয়েকটি জেলার লক্ষাধিক মানুষ। তেল, লঙ্কা, পেঁয়াজ, টোম্যাটো, ধনেপাতার সঙ্গে নারকেল, ঘুগনি, চপ, শসা, মুলো, নারকেল নাড়ুর এলাহি আয়োজন। শীতের আমেজে প্রায় ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে দ্বারকেশ্বরের চরে রমরমিয়ে চলছে মুড়ি মেলা। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে যা মুড়ি উৎসব নামে পরিচিত।
বাঁকুড়া-১ ব্লকের কাছে কেঞ্জাকুড়া। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে দ্বারকেশ্বর। এই নদের পাড়ে রয়েছে সঞ্জীবনী মাতার আশ্রম। এই আশ্রমে বহু প্রাচীন কাল থেকে মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে হরিনাম সংকীর্তন হয়ে আসছে। ফি বছর সেই নাম-সংকীর্তন চলে মাঘ মাসের প্রথম সপ্তাহ-জুড়ে। আর শেষ দিন ৪ তারিখে বসে মেলা। ঝাল-তেল-মশলা-আনাজ সহযোগে শুধু মশলা মুড়ি নয়, এই মেলায় মুড়ি খাওয়ার আরও একটা রেওয়াজ আছে। নদের তীরে গর্ত খুঁড়ে জল বের করে সেই জলে ভিজিয়ে মুড়ি খাওয়াটাই এখানে রীতি। অতীতে তেমনটাই হতো। রীতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস।
কেঞ্জাকুড়ার বাসিন্দা লালচাঁদ চন্দ বলেন, প্রায় ২০০ বছর ধরে এই মেলা চলে আসছে। প্রচলিত আছে, ভাণ্ডারবেড় গ্রামের রায়কিশোর চট্টোপাধায় জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি যুবক বয়সে সন্ন্যাস নিয়ে তীর্থক্ষেত্রে চলে যান। পরে তিনি গ্রামে ফিরে আসেন। কিন্তু, শর্ত দেন, তিনি কারও বাড়িতে থাকবেন না। তাঁর জন্য দ্বারকেশ্বর নদের তীরে বাড়ি বানিয়ে দিতে হবে। সেই বাড়িই এখন সঞ্জীবনী মন্দির। কথিত আছে, আগে এই এলাকা ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল। তার মাঝে থাকা আশ্রমে দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা হরিনাম শুনতে আসতেন। আশ্রম লাগোয়া জঙ্গলে হিংস্র জীবজন্তুর ভয় থাকায় হরিনাম শোনার পর সন্ধ্যায় কেউই বাড়ি ফিরতে সাহস করতেন না। সঙ্গে করে বেঁধে আনা মুড়ি-বাতাসাই ছিল ভরসা। পরের দিন নদীর জলে মুড়ি ভিজিয়ে খেয়ে গ্রামবাসীরা বাড়ি ফিরতেন। মুড়ি খাওয়ার সেই রেওয়াজ ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে শুরু করে এলাকাবাসীর মধ্যে। যা আজ মেলার চেহারা নিয়েছে।
কেঞ্জাকুড়ার বাসিন্দা তীর্থ কাইতি বলেন, মকর সংক্রান্তির দিন থেকেই আশ্রমে লোকের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। ৩ মাঘ রাত থেকেই আশপাশের ৫০-৬০টি গ্রামের মানুষ ভিড় জমান কেঞ্জাকুড়ায়। এখন পুরুলিয়া, বর্ধমান, ঝাড়গ্রাম এমনকী ঝাড়খণ্ড থেকেও প্রচুর মানুষ এই মেলায় হাজির হন। সঙ্গে করে বেঁধে আনেন মুড়ি, চপ থেকে মরশুমি আনাজ। নদীর চরে থালা সাজিয়ে চলে মুড়ি মাখা। কাজের সূত্রে যাঁরা গ্রামের বাইরে থাকেন, বছরের এই দিনগুলিতে ফিরে আসেন নিজের গ্রামে। হই হুল্লোড়, খাওয়া দাওয়ায় রীতিমতো উৎসব মুখর হয়ে ওঠে দ্বারকেশ্বরের চর। পুরুলিয়ার হুড়া থেকে আসা জয়দেব মাহাত বলেন, আমি প্রায় ১০ বছর ধরে বন্ধুদের সঙ্গে এই মেলায় আসছি। নদীর চরে সারাদিন হইহুল্লোড় আর বন্ধুদের সঙ্গে রকমারি সব্জি ও চপ দিয়ে মুড়ি খেয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যাই।