পারিবারিক সম্পত্তি বিক্রয়ে অর্থাগমের যোগ। যেকোনও ঝামেলা ঝঞ্ঝাট এড়িয়ে চলুন। ... বিশদ
শিবের বিয়ে নবদ্বীপের একটি আঞ্চলিক উৎসব। এই উৎসব কত প্রাচীন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। চৈত্রমাসে বাসন্তীপুজোর শেষদিন শিবের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। ইতিহাসবিদরা কেউ কেউ মনে করেন, নবদ্বীপের এই উৎসব অন্তত ৫০০ বছরের প্রাচীন। কেউ কেউ এই উৎসব ৩০০ বছরের প্রাচীন বলে মনে করেন। এনিয়ে একসময় গানও রচিত হত। নবদ্বীপের শিবের বিয়ে নিয়ে মেতে উঠেছে এলাকার বাসিন্দারা।
শোনা যায়, আগে শিবের বিয়ে খুব ধুমধাম করে হত। সন্ধ্যা নামলেই কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বলত নবদ্বীপের ঘরে ঘরে। চৈত্রের শুক্লা দশমীর মধ্যরাতে নগরের পথে তুমুল শোরগোলে ঘুম ভেঙে যায় নবদ্বীপবাসীর। তাঁরা দেখতেন, সারি সারি মশাল ও গ্যাসবাতির রোশনাইয়ে ঝলমলে চোখ ধাঁধানো একটি বিয়ের বরযাত্রী যাচ্ছে। সুসজ্জিত পালকির ভিতরে লাল মখমলের উপর বসানো রুপোর থালায় চূড় দিয়ে সাজানো রয়েছে রুপোর মোহর। বাকি শোভাযাত্রা জুড়ে ঠেলাগাড়িতে একের পর এক দৃশ্যপট সাজানো। দেবদেবীর মূর্তি, ভূত, পিশাচ, নকল বাগান। বাজত ঢাকঢোল, সানাই, ব্যান্ডের গান। ফাটত বাজি। বরপক্ষকে চমক দিত কনেপক্ষ। শিবের বিয়ে দেখার জন্য বছরভর অপেক্ষা করতেন নবদ্বীপবাসী। চৈত্রের শুক্লা দশমীর রাত শিবের বিয়ের রাত বলেই পরিচিত। যদিও পঞ্জিকা মতে চৈত্র মাসে বিবাহ নাস্তি। বাসন্তী পুজো সমাপ্ত হলে, পাঁচদিন ধরে অনুষ্ঠিত হওয়া বাসন্তী পুজোর সুসজ্জিত মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমার সঙ্গে নবদ্বীপের মন্দিরে অধিষ্ঠিত শিবের বিবাহ সম্পন্ন হয়। বাসন্তীপুজোর ভোরে শিবের মুখোশ তৈরি করে চতুর্দোলায় বর সাজানো হয়। অন্যদিকে, বাসন্তী ঠাকুরকে দোলায় সাজিয়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরিয়ে অবশেষে পোড়ামাতলায় নিয়ে আসা হতো। সেখানে বাঙালি হিন্দুবিবাহ রীতি মেনে শিব ও মহিষাসুরমর্দিনীর বিয়ে দেওয়া হতো। এখন আর পোড়ামাতলায় বিয়ের অনুষ্ঠান হয় না। সেই অনুষ্ঠান হয় শিবমন্দির সংলগ্ন এলাকায়। সাতপাকে ঘোরা থেকে শুরু করে মালাবদল সবই হয়। এরপর আতশবাজির প্রদর্শনী হয়। বিয়ের পর আগত দর্শনার্থীদের জন্য খাওয়ানোর ব্যবস্থাও করেন আয়োজকরা। লুচি-আলুরদম, মিষ্টি, খিচুড়ি, পোলাও, পায়েস ইত্যাদি খাওয়ানো হয়। আজও এই প্রাচীন ধারা একইভাবে পালিত হচ্ছে। এখন বুড়োশিবতলা, যোগনাথতলা, চারিচারাপাড়া এবং বউবাজারের যথাক্রমে বুড়োশিব, যুগনাথ বা যোগনাথ, বালকনাথ এবং মালোদের শিব বানেশ্বরের বিয়ে হয়। জাঁকজমকপূর্ণভাবে মন্দিরের পাশে বিশাল মঞ্চ বাঁধা হয়। সেখানে পোশাক থেকে আসবাব, সাইকেল থেকে কাঁসা-পিতলের বাসনপত্র। বাইক থেকে ফ্রিজ, এসি প্রভৃতি যৌতুক হিসেবে মঞ্চে রাখা হতো। শহরের বড় বড় দোকান থেকে ব্যবসায়ীরা আনন্দের সঙ্গে ওই সব জিনিস বিয়ের বাসর সাজাতে পৌঁছে দেন। তবে এবছর বানেশ্বর শিব ও চারিচারা বাজার এলাকায় বালকনাথ শিবের বিয়ের মঞ্চ বাঁধা হবে না। বানেশ্বর শিবের পুরোহিত গৌর চক্রবর্তী বলেন, বিয়ে হলেও সাজানো হবে না বিয়ের মঞ্চ। অন্যদিকে, স্থানীয় কাউন্সিলার ভারতী ভট্টাচার্য বলেন, বাবার বিয়ের পরের দিন পয়লা বৈশাখ। ফলে চারিচারা বাজার এলাকায় বালকনাথ শিবের বিয়েতে বাঁধা হবে না মঞ্চ। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, শিবের বিয়ে মূলত হয় বিহারের বৈদ্যনাথ ধামে। বাঁকুড়ায় গানের মাধ্যমে শিবের বিয়ে হয়। নবদ্বীপের এটি একটি লৌকিক উৎসব। সতেরোশো খ্রিস্টাব্দ থেকে বাবার বিয়ে অর্থাৎ শিবের বিয়ের ইতিহাস পাওয়া যায়। সেকালে এক একজন ধনী মানুষ এক একটি শিবের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী অনুষ্ঠানের সময় পোলাও, খিচুড়ির ভোজ হতো। শিবের বিয়েকে কেন্দ্র করে গান লেখা হতো। নবদ্বীপ হিন্দু স্কুলের শিক্ষক শিশির চট্টোপাধ্যায় নিজেই ছিলেন লেখক, গীতিকার ও সুরকার। শিবের বিয়ে উপলক্ষে তিনি প্রচুর গান রচনা করেছিলেন। শিবের বিয়ে নিয়ে নবদ্বীপের উন্মাদনা আজও একই রকম।