রাজনীতিক ও পেশাদারদের ব্যস্ততা বাড়বে। বয়স্করা শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিন। ধনযোগ আছে। ... বিশদ
স্বাধীনতার পরবর্তীকালে, পঞ্চাশের দশকের শুরুতে, মালদহের ধ্রুপদ সঙ্গীতের অন্যতম পথিকৃৎ শিল্পী সাতু সাটিয়ার এখানে প্রথম উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর বসান। তাঁর উদ্যোগে সেই সময়কার খ্যাতনামা শিল্পী নারায়ণ রাও যোশি, রসলুন বাইয়ের মতো খ্যাতনামা শিল্পীরা মালদহে এসেছিলেন। সেই সময় গানের সঙ্গে সঙ্গতে তবলার পথও প্রশস্ত হতে থাকে। মধুসূদন চৌধুরী ছাড়াও বিশ্বনাথ বসাক গোপাল বারুড়ি প্রমুখ শিল্পী পন্ডিত বিষ্ণুসেবক মিশ্রর উদ্যোগে সঙ্গীতচর্চায় এগিয়ে আসেন। গান, তবলা সেতার-সবেতেই ছিল পন্ডিতজির অবাধ রিচরণ। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ধারাটি মালদহে সেইসময় যথেষ্ট চলমান হলেও জনপ্রিয়তার নিরিখে তার স্থান সেই সময় খুব উঁচুতে ছিল, একথা বলা যাবে না। শ্রোতার সংখ্যা ছিল সীমিত। সমঝদার লোকের অভাব অবশ্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বরাবরই পরিলক্ষিত হয়েছে। কণ্ঠশিল্পীর অভাব ছিল না। সেক্ষেত্রে মেয়েদের মধ্যে এগিয়ে আসেন আরতী বাগচি, সীমা বারুড়ি, যোশী চাকি, খুশি পাল প্রমুখ। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠে গান শেখার বহু প্রতিষ্ঠান। শিল্পীদের চাহিদাও বাড়তে থাকে। ষাট ও সত্তরের দশকে পুরনো প্রজন্মের শিল্পীদের সঙ্গে সঙ্গে আসেন দুই ভাই ইউনুস খাঁ ও খালেক ভাই।
সেই সময় থেকেই গড়ে ওঠে নানা সঙ্গীত সংগঠন ও গোষ্ঠী। সত্তরের দশকে তৈরি ‘গৌড়মল্লার’ ভারত বিখ্যাত শিল্পীদের এনে মালদহের মানুষকে গান শোনার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। এছাড়াও ছিল ইউনুস খা’র প্রতিষ্ঠিত ‘সররঙ্গ’। তারাও বেশ কিছু উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। এরপর আশির দশকে শিল্পীরা মিলিতভাবে গড়ে তোলেন শিল্পী সংসদ। পরবর্তীকালে ইউনুস খাঁ’র পুত্রের উদ্যোগে গঠিত হয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতিষ্ঠান ‘জলসাঘর’।
সঙ্গীতপ্রেমী ত্রিদিব সান্যালের মতে, মালদহের মাটিতে যেমন আম, রেশম, ধান আছে, তেমনই গানও আছে। এখানে গুণী শিল্পীর কখনও অভাব হয়নি।
মালদহের প্রতিষ্ঠিত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী শাহাদত রানা খান বলেন, সত্তরের দশকের মালদহের ধ্রুপদী সঙ্গীতের চল ছিল সেই সময়কার গুরুদের হাত ধরে। সেই চর্চা বর্তমানে অব্যাহত। সেটা আরও গতি পেত যদি আমরা সেই সময়কার গুরুদের কাছ থেকে এর নির্যাস ঠিকমতো নিতে পারতাম। এটা আমাদের ব্যর্থতা। পিছিয়ে পড়ার আরেকটি মুখ্য কারণ হচ্ছে, এই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সরকারি কোনও পৃষ্ঠপোষকতা নেই। জেলায় সরকারি খরচে অনেক অনুষ্ঠান হয়, কিন্তু এই ধ্রুপদী সঙ্গীতকে কোথাও কোনও প্রাধান্য দেওয়া হয় না। এই প্রাধান্য না পাওয়ার কারণেই জেলার শিল্পী মহলে একটা অনীহা দেখা দিয়েছে। ক’জন শিল্পী নিজে শেখেন, ছাত্রছাত্রীকে শেখান আবার নিজের রুটি-রোজগারের চিন্তাও তাঁকে করতে হয়। শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অধ্যাবসায় ও সাধনা দরকার। যদি ব্যাগ নিয়ে বাড়ি বাড়ি ছাত্র শেখাতে যেতে হয়, তখন সেটা আর শিল্প থাকে না। জেলায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে বছরে একটা-দুটো অনুষ্ঠান আমরা নিজেরাই করি। এর মধ্যে দিয়ে যতটুকু চর্চা হয়, সেটাই আমাদের কাছে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে পাথেয়।
মালদহের আরও এক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী শুভজ্যোতি দাস বলেন, মালদহে বর্তমানে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করে সার্বিক ব্যাপার বলা যেতে পার। আমি যখন সঙ্গীতজীবন শুরু করি তখন এখানে পন্ডিত বিষ্ণুসেবক মিশ্র ছিলেন না। তবে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে গুরুপ্রসন্ন বারুড়ি, তাঁর ভাই গোপাল বারুড়ি ও তাঁর স্ত্রী সীমা বারুড়ি এবং রুবি রায় প্রমুখ ছিলেন। শুদ্ধতার দিক দিয়ে, শেখা ও শেখানোর দিক দিয়ে বিচার করলে সীমা বারুড়ি অত্যন্ত জ্ঞানী শিল্পী ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, এই ধারাকে যেন তাঁর উত্তরসূরি এবং ছাত্রছাত্রীরা ধরে রাখে। সীমা বারুড়ির ছেলে অভিজিৎ বারুড়ি বর্তমানে মালদহের একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। গোটা রাজ্যেই তাঁর সুনাম রয়েছে। এছাড়া তবলায় আছেন দিব্যেন্দু বসাক। বর্তমানে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা যাঁরা করছেন, তাঁদের সংখ্যা খুবই কম। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গেই অনেকে লঘু সঙ্গীতেরও চর্চা করছেন। এর ফলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ফিকে হয়ে যাচ্ছে। রাগের যে সঠিক রূপ, তাকে যদি ধরে না রাখতে পারি, তাহলে সেটা সঠিকভাবে পরিবেশিত হয় না। পরিপূর্ণতাও লাভ করে না। এখনকার ছাত্রছাত্রীরা ইন্টারনেটের দৌলতে অনেক ভালো কিছু শেখার সুযোগ পাচ্ছে। শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চা শুধু বর্তমানে নয় ,আগেও চর্চা অন্যান্য সঙ্গীতের চর্চার চেয়ে কমই ছিল। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শাস্ত্রসম্মতভাবে গাইতে গেলে প্রয়োজন নিয়মিত রেওয়াজ, সঠিক শিক্ষা। সঠিক গুরু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নিজেকে দীর্ঘকালীন অভ্যাসের মধ্যে নিয়োজিত করলে তবেই সাফল্য আসবে।
আরও এক প্রতিষ্ঠিত মহিলা শিল্পী অন্তরা বিশ্বাস বলেন, আমরা যখন ছোটবেলায় গান শিখতাম, তখন পড়াশোনার এতটা চাপ ছিল, কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের পড়াশোনার এতটাই চাপ যে, তারা পড়াশুনা ছাড়া অতিরিক্ত কিছু করে উঠতে পারে না। হয়তো বাবা-মায়ের চাপে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আসে। কিন্তু এলেও সেখানে সময় দিতে পারে না। আমরা পরীক্ষার সময়ও গানের রেওয়াজ করেছি। আগেকার দিনে পড়াশোনা সঙ্গে সঙ্গে গানবাজনার জন্য একটা আলাদা সময় আমরা ঠিক করে রাখতাম। সেই জিনিসটা এখন আর নেই। শিশুরা টিভির দৌলতে রিয়েলিটি শোতে যাচ্ছে। গান গাইছে। তারপর তাদের আর কোনও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু তাদের দোষ দিলেই হবে না, মা-বাবাদেরও দোষ আছে। তাঁরা যখন সন্তানদের শেখাতে নিয়ে আসছেন, তখন বলছেন আমার ছেলে বা মেয়ে কতদিনে রিয়েলিটি শোতে নামতে পারবে বা টিভিতে অনুষ্ঠান করতে পারবে। এই ধরনের মানসিকতা খুব খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ছাত্রদের। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জন্য যে পরিমাণ রেওয়াজ প্রয়োজন, এখনকার বাচ্চারা তা করছে না। তবে এর মধ্যেও আশার আলো যে জেলায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা আগের চেয়ে বাড়ছে।