বিএনএ, কোচবিহার: কোচবিহারের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভাওয়াইয়া সঙ্গীত। একে সজীব রাখতে ভাওয়াইয়া সঙ্গীত চর্চা কেন্দ্র খুলেছেন ভাওয়াইয়া শিল্পী প্রদীপ সিংহ সরকার। ষাটোর্ধ্ব প্রদীপবাবু তাঁর বাড়ির পাশেই এই কেন্দ্র খুলে প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেখানে ভাওয়াইয়া গান চর্চা করেন। একা একা সঙ্গীত চর্চা নয়, সকলকে শামিল করে বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি এই কেন্দ্র চালিয়ে যাচ্ছেন। তুফানগঞ্জের দেউচড়াই পাটেশ্বরী ভাওয়াইয়া সঙ্গীত চর্চা কেন্দ্রের পাশ দিয়ে গেলে তাই প্রতি সন্ধ্যাতেই কানে ভেসে আসে ভাওয়াইয়া গানের মন মাতানো সুর। এই গানের আরও উন্নতি সাধন করতে চান প্রদীপবাবু। তাঁর দাবি, এই গানের উন্নতির লক্ষ্যে ওয়ার্কশপ, শিল্পীদের নিয়ে সম্মেলন হওয়া দরকার। নিজে ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের আবহে বড় হয়ে উঠেছেন। ছোটবেলা থেকে ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দিনের গল্প শুনে বড় হয়েছেন। এই সঙ্গীত যেন তঁর রক্তে মিশে রয়েছে। তাই তিনি ভাওয়াইয়া গানের আরও প্রসার ও সমৃদ্ধি চান।
প্রদীপবাবু বলেন, খুব ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে সঙ্গীতের পরিবেশ ছিল। বাড়ির কাছারিতে গানের আসর বসত। বাড়িতে যাঁরা চাষের কাজ করতেন, তাঁদের অনেকে ভাওয়াইয়া গান গাইতেন। তাঁদের থেকে শুনে শুনে গান গাওয়া শুরু। সেইসঙ্গে বাড়িতে ছোট থেকেই ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দিন সাহেবের নানা গল্প শুনেছি। তিনি আমার কাকার সঙ্গে গল্প করতে আমাদের বাড়িতেও আসতেন। পরবর্তীতে আমি ভাওয়াইয়া রিসার্চ প্রজেক্টে কাজ করেছি। কয়েক বছর আগে আমি দেউচড়াই পাটেশ্বরী ভাওয়াইয়া সঙ্গীত কেন্দ্র খুলেছি। সেখানে ভাওয়াইয়া গানের বহু বিখ্যাত শিল্পী এসেছেন। এখানে প্রতিদিন ভাওয়াইয়া গানের চর্চা হয়।
কোচবিহার সহ প্রায় গোটা উত্তরবঙ্গ ও অসমের বিস্তীর্ণ এলাকায় ভাওয়াইয়া গানের প্রচলন প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে। কোচবিহারের মাটি ও মানুষের সঙ্গে এই গান সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে। সেই ভূমিতেই প্রদীপবাবুর জন্ম। এক সময়ে তাঁদের পারিবারিক জমিতে প্রচুর ফসল উৎপাদন হতো। সেসব কাজের জন্য অনেক মানুষ বাড়িতে থাকতেন। তাঁরাই বাড়িতে গানের আসর বসাতেন। প্রতি বছর এলাকার কালজানি নদীতে নৌকা বাইচ হতো। বাইরে থেকে অনেক নৌকা আসত। বাইচের অনুশীলনের সময়ে গান হতো। আবার মাঠে ধান ও পাট নিড়ানির সময়ে বড়াদি পাইটের গান হতো। এই আবহে বড় হয়ে ওঠা ও সেসব গান শুনে শুনে ছোটবেলা থেকে ভাওয়াইয়া, বাউল, সত্যপীরের গান, নৌকা বাইচের গান তাঁর অন্তরের গভীরে স্থান করে নিয়েছিল।
এরপর স্কুল, কলেজের দিনগুলিতে নানা জায়গায় তিনি গানের তালিম নিয়েছেন। বন্ধুদের কাছ থেকে শিখেছেন বহু রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজানো। এরই মধ্যে সময় পেরিয়ে গিয়েছে। একসময় ভাওয়াইয়া শিল্পী ও দক্ষ প্রশাসক সুখবিলাস বর্মার ইচ্ছায় ভাওয়াইয়া রিসার্চ প্রজেক্টের কাজ নিয়ে অসমেও দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন। বছর পাঁচেক আগে তিনি দেউচড়াহিত ভাওয়াইয়া সঙ্গীত চর্চা কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন। সেখানেই চলে ভাওয়ায়া সঙ্গীতের চর্চা।
প্রদীপবাবু বলেন, আমার সঙ্গীত চর্চা কেন্দ্রে প্রখ্যাত ভাওয়াইয়া শিল্পী নজরুল ইসলাম, অসমের প্রতিষ্ঠিত ভাওয়াইয়া শিল্পী ললিত রায়, মিনাজুল হক সহ বহু শিল্পী এসেছেন। অনেকেই এখানে এসে নিয়মিত এই সঙ্গীতের চর্চা করেন। সাধারণ শিল্পী যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের জন্য সরকারিভাবে ওয়ার্কশপ হওয়া দরকার। তাহ঩লে আগামী দিনে ভাওয়াইয়া সঙ্গীত আরও প্রসার লাভ করবে।