কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
স্বর্গের দেবতাকে মাটির মানুষ বানিয়ে ফেলা বাঙালির চিরকালীন ট্র্যাডিশনের মধ্যে অন্যতম। সেই অভ্যাসেই দেবী হয়ে যান আমাদের ঘরের মেয়ে উমা, আবার উমাপতি শিব হয়ে ওঠেন আমাদের ‘ঘরের বুড়ো’। গম্ভীরা আসলে সেই ঘরের বুড়ো শিবেরই বন্দনাগীতি।
প্রাচীনকাল থেকেই চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ-এই তিন মাসে শিবের পুজো হয়ে আসছে বিভিন্ন জনপদে। যাঁরা শিবের পুজো করেন, তাঁরা আগের দিন উপবাস করেন। দ্বিতীয় দিন মুখা অর্থাৎ মুখোশ পরে গান গেয়ে গেয়ে ঘুরে বেড়ান গ্রামের পথে প্রান্তরে। গ্রামের ছোট ছোট স্থানীয় সমস্যাগুলোকে নিয়ে তাঁরা খোল করতাল বাজিয়ে কৌতুক আকারে নৃত্য সহ পরিবেশন করেন। তাকেই গম্ভীরা গানের পূর্বপুরুষ বলা চলে। পরবর্তীকালে সেটাকে একটা আকার দেওয়া হয় এবং ধীরে ধীরে তা জনপ্রিয়তাও লাভ করে। সেটাকে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে দেন শিল্পীরা। ক্রমে তা আঞ্চলিক পর্যায়ে এবং পরবর্তীকালে রাজ্য পর্যায়ে উঠে আসে।
শিবের নাম থেকেই গম্ভীরা
গম্ভীরা নামটিও এসেছে শিবের নাম থেকেই। শিবের আরেক নাম গম্ভীর। পাল রাজাদের আমলে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে হিন্দুধর্মের একটা যোগসূত্র গড়ে উঠেছিল। শিবের যে আরও এক নাম গম্ভীর, তা কিন্তু সেই যোগসূত্রেরই পরিচয় বহন করে। কারণ বৌদ্ধধর্মের এক দেবতার নামও ছিল গম্ভীর। অবিভক্ত বাংলায় বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে শৈবরা শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করে পুজো উপলক্ষে সামিয়ানা টাঙিয়ে গান করার মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তোলে এই গম্ভীরা গীতিকে। দেবদেবীর ছোঁয়া থাকলেও বিষয়টি কিন্তু একচেটিয়া হিন্দুদেরই ছিল না।
গম্ভীরা মালদহের নিজস্ব লোক নৃত্যনাট্য
মালদহের গম্ভীরা গান পশ্চিমবঙ্গের লোকগান, লোকনাটক বা লোকসঙ্গীতের যত প্রকারভেদ রয়েছে তার মধ্যে এটা এক অন্যতম আঙ্গিক। গম্ভীরাকে মালদহ জেলার নিজস্ব লোক নৃত্যনাট্য কৌতুকাভিনয় এই ভাবেই বলা হয়ে থাকে। এর মধ্যে নৃত্য, গান, অভিনয় ও কৌতুকনকশা সবই রয়েছে। মালদহের ইতিহাসে আদিকাল থেকে যে গম্ভীরার বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে এই সব বিষয় ছিল না। সময়ের পরিবর্তনে মানুষের ভাবনার বিকাশে এবং ভাবনার যুগপোযোগী পারিপার্শ্বিক উত্থানপতনের বাস্তবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গম্ভীরার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু রদবদল ঘটেছে স্বাভাবিক কারণেই। মালদহ জেলার গম্ভীরা মানবপুতুল, ডোমনী ও ঝাড়নিগান পঞ্চরস ইত্যাদি লোক শিল্পের মধ্যে ছড়িয়ে আছে।
পরম্পরা
গম্ভীরা গানের প্রবাদ পুরুষ প্রয়াত যোগেন্দ্রনাথ চৌধুরী। তিনি মালদহের গম্ভীরা গানের জগতে ‘মটরা’ নামে খ্যাত। তাঁর অবদান গম্ভীরা জগতে অস্বীকার করা যায় না। গম্ভীরা গানের শিল্পীরা তাঁর নামেই শ্রদ্ধায় মাথা নত করেন। গম্ভীরা গানকে সমাজে জনপ্রিয় লোকশিল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন। তাঁকে দেখেই পরবর্তীকালে বহু শিল্পী গম্ভীরা গাইতে আসেন। ওই সময় বিশ্বনাথ পণ্ডিতের দলও যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। সেই দলে শিব সাজতেন দুর্গা পণ্ডিত। সে সময় তারাপদ সরকার, বিমল গুপ্তরাও গম্ভীরাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন।
বর্তমানে মালদহ জেলার গম্ভীরা শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম অমর মণ্ডল। রয়েছেন প্রশান্ত পালাকার, অশোক চক্রবর্তী, অদ্বৈত বিশ্বাস, অসীম রায়, মনোরঞ্জন মণ্ডলরাও। অমরবাবু প্রায় ৩৫ বছর ধরে গম্ভীরা গানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। তিনি ৯২-৯৩ সালে মালদহ কোর্ট স্টেশন সংলগ্ন ময়দানে গম্ভীরা গানের প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে সে বছরই সল্টলেক স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠান করতে যান। সেখানেও তিনি প্রচুর প্রশংসা পেয়েছেন। কলকাতায় অনুষ্ঠিত বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে তিনি তাঁর গম্ভীরা দল নিয়ে অনুষ্ঠান করেছেন।
আজকের অবস্থা
অনেকে বলেন, গম্ভীরার জৌলুস আস্তে আস্তে কমছে। কিন্তু অমরবাবুর মতো শিল্পীরা সেকথা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, আমাদের মতো বেশ কয়েকটি দল এই গানকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এখনও। সেজন্য আধুনিক সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে রাজ্য ও দেশের বিভিন্ন জ্বলন্ত সমস্যাকে গান ও কৌতুক সহকারে পরিবেশন করা হচ্ছে আধুনিক গম্ভীরায়।
বর্তমানে মালদহে গম্ভীরা গানের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গম্ভীরাকে সঠিকভাবে উপস্থাপিত করতে না পারার জন্য এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের প্রচারে গম্ভীরাকে ব্যবহার করার জন্য এবং বর্তমান সমস্যাকে গানের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পারার ফলে গম্ভীরার বিশেষত্ব হারাচ্ছে। তিনি বলেন, জ্বলন্ত সমস্যা ও বিষয়কে যত বেশি কমেডি করে হাস্যরস সৃষ্টি করা যাবে মানুষ তত বেশি উপভোগ করবে। কারণ মানুষ হাসতে বেশি ভালোবাসেন। এর মধ্য দিয়ে গম্ভীরা গানের জনপ্রিয়তা বাড়বে।
সরকারি উদ্যোগের অভাব
মালদহ জেলার এই লোক সংস্কৃতিকে ব্যাপক আকারে ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার সরকারি উদ্যোগের অভাব রয়েছে রয়েছে বলে শিল্পীদের আক্ষেপ। তাঁদের মতে, সরকারি উদ্যোগ ছাড়া এটা সম্ভব নয়। এটা করা গেলে অনেক গম্ভীরা শিল্পী উপকৃত হতো।
অমলবাবু বলেন, বিগত সরকারের আমলে শিল্পীদের কার্ড দেওয়া শুরু হয়। তারপর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আগের সরকারের দেওয়া সেই কার্ড বাতিল করে নতুন করে কার্ড বিলি করা হয়। এর ফলে বহু পুরানো শিল্পী কার্ড পাননি। যার ফলে তাঁরা সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই ব্যাপারে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে যাতে সকল পুরানো শিল্পী এই কার্ড পেতে পারেন। বর্তমান প্রজন্মকে গম্ভীরার প্রতি আরও বেশি করে আকৃষ্ট করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।