সংবাদদাতা, পুরাতন মালদহ: সোমবার মালদহ শহরের বেহুলা নদীর তীরে ষষ্ঠীতলায় অনুষ্ঠিত হল ঐতিহ্যবাহী জুয়াড়ি মেলা। এটি এমন এক মেলা যেখানে ঐতিহ্যের সঙ্গে ধর্ম ও বিনোদন, সবকিছুই জড়িয়ে রয়েছে। মনসামঙ্গল কাহিনীর সঙ্গে জড়িত এই ঐতিহ্যবাহী মেলার মূল আকর্ষণ জুয়া খেলা। মূলা ষষ্ঠী উপলক্ষে শহরের ষষ্ঠীতলায় জুয়াড়ি মেলা জমজমাট হয়ে ওঠে। প্রচুর লোক সমাগমে রমরমিয়ে হয় জুয়া খেলা। যুবক-যুবতী থেকে শুরু করে শিক্ষক-শিক্ষিকা সহ সমাজের বিশিষ্টজনেরাও ওই ঐতিহ্যবাহী জুয়াড়ি মেলায় অংশ নিয়ে নিজের নিজের ভাগ্যপরীক্ষা করেন। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, সকাল থেকেই এই মেলা বসে। একটি গাছের নীচে ভোগ নিবেদনের করার পরেই জুয়া খেলা শুরু হয়ে যায়।
এবিষয়ে পুরাতন মালদহ শহরের গৌড় কলেজের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক বিজয় ঘোষ বলেন, এরই নাম ভারতীয় সংস্কৃতি। মেলাস্থলে গিয়ে আমি দেখলাম একটা সম্পূর্ণ অন্য ধরনের মেলা। আগে অনেকবারই এই মেলার কথা শুনেছি। এদিন এসে তাজ্জব বনে গেলাম। মহিলা-পুরুষে কোনও ভেদাভেদ নেই। সকলেই মেলা উপভোগের পাশাপাশি নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষা করতে জুয়া খেলেছেন। আমার মনে হয় না, অন্য কোথাও এধরণের সংস্কৃতি রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা প্রাচীন পরম্পরা যে ধরে রাখতে পেরেছেন, সেটা দেখে খুব ভালো লাগল।
স্থানীয় বাসিন্দা সঞ্জীব হালদার বলেন, এই মেলা বহু প্রাচীন। এটি মূলা ষষ্ঠীর জুয়াড়ির মেলা নামেই পরিচিত। চিনি দিয়ে বিশেষ এক ধরণের খাবার তৈরি হয়। তাকে বলে লেওরি। সেই লেওরি একমাত্র এখানেই পাওয়া যায়। সেই লেওরি ষষ্ঠী তলায় নিবেদন করে অনেকে জুয়া খেলতে যান। দূরদূরান্ত থেকে প্রচুর মানুষ মেলার টানে ছুটে আসেন। মালদহ থানার আইসি শান্তিনাথ পাঁজা বলেন, মূলা ষষ্ঠীর মেলা শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে।
পুরাতন মালদহের নবাবগঞ্জ হয়ে পুরাতন মালদহ রেল স্টেশনের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে বেহুলা নদী। সেই নদীর পাশেই তিন নম্বর ওয়ার্ডের ষষ্ঠীতলায় এই মেলার আয়োজন করা হয়। এলাকার মহিলারা সন্তানের মঙ্গল কামনার জন্য ষষ্ঠীতলার একটি গাছে মুলা ষষ্ঠীর পুজো করেন। একমাত্র এই মেলাতেই বিক্রি হওয়া লেওরি ভোগ হিসেবে ষষ্ঠী তলায় নিবেদন করা হয়। কথিত আছে, মনসামঙ্গলে চর্চিত বেহুলা ওই নদী দিয়ে তাঁর স্বামীর মরদেহ সঙ্গে নিয়ে কলার ভেলায় চেপে ভেসে যাচ্ছিলেন। সে সময় জুয়াড়ি জুয়া খেলায় সর্বস্ব খুইয়ে ষষ্ঠীতলার ঘাটে বসে কাঁদছিলেন। ওই জুয়াড়িকে কাঁদতে দেখে বেহুলা তাঁর দুঃখের কারণ জানতে চান। জুয়াড়ি জানান, তিনি এলাকার এক বাগানে জুয়া খেলে সর্বস্ব খুইয়ে ফেলেছেন। তাই তিনি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ ত্যাগ করবেন। সে সময়ই বেহুলা তাঁর হাতের সোনার চুড়ি ওই জুয়াড়িকে দিয়ে বলেন, সেটি বাজি রেখে জুয়া খেললে তিনি তাঁর হারানো ধন ফিরে পাবেন। বেহুলার দেওয়া চুড়ি নিয়ে জুয়াড়ি জুয়া খেলায় বসেন। পরে তিনি সর্বস্ব ফিরে পেয়েছিলেন। তখন থেকেই ওই এলাকায় জুয়ার মেলার আয়োজন হয়। সে মেলা আজও মনসামঙ্গলের কাহিনী ও ঐতিহ্য বহন করে আসছে। এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে, এই মেলায় জুয়া খেললে ধনবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। তাই অনেকেই উৎসাহের সঙ্গে মেলায় জুয়া খেলায় অংশ নেন।