সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক। কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার বা ... বিশদ
এই কীটনাশক নিয়ে মার্কিন মুলুকে রয়েছে অন্য এক গল্প। মার্কিন নাগরিকদের পরিবেশ চেতনা জাগরণের গল্প। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকায় কীটনাশক শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। কৃষিজমির ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ বিনাশে এবং মানুষের জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার জন্য মশা-মাছির উপদ্রব কমাতে গোটা আমেরিকা জুড়ে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। কিন্তু, তখনও এই কীটনাশকের ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে কারও কোনও ধারণা ছিল না। এমনই এক সময়ে ম্যাসাচুসেটসের ডাকসবেরি অঞ্চলের পোকামাকড় ও মশা নিধন করতে কর্তৃপক্ষ ডিডিটি নামে একধরনের কীটনাশক ছোট বিমানের সাহায্যে শহর জুড়ে স্প্রে করতে শুরু করে। শহরবাসীদের এ নিয়ে তেমন কোনও মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু, এই ঘটনার কয়েকদিন পর ওই অঞ্চলেরই ওলগা ওয়েন্স হাকিন্সের পক্ষীশালার বেশ কিছু পাখিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এই হঠাৎ মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের দায়িত্ব নিলেন ওলগার বান্ধবী র্যাচেল কার্সন। মৃত পাখিদের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে তিনি জানতে পারলেন, এর জন্য ডিডিটিই দায়ী। র্যাচেল ডিডিটি নিয়ে আরও পরীক্ষা চালান। ডিডিটির ক্ষতিকর প্রভাব দেখে অবাক হয়ে যান তিনি। র্যাচেল সবাইকে জানাতে লাগলেন ডিডিটির ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা। যার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষ সহ সমগ্র জীবজগৎ। ডিডিটির কারণে মানুষের স্নায়ুঘটিত রোগ, ক্যান্সারেরও আশঙ্কা থাকে। ডিডিটির এই অন্ধকার দিকটি র্যাচেল সকলের সামনে তুলে ধরলেন তাঁর বই ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’-এ। ১৯৬২ সালে বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপক আলোড়ন তোলে গোটা বিশ্বজুড়ে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ার স্প্রিংডেল। বাদামি চুলের মিষ্টি মেয়েটি তার ছোট্ট পোষা কুকুর ‘ক্যান্ডি’র সঙ্গে তাদের ছোট্ট ফ্যামিলি ফার্ম জুড়ে দৌড়ে বেড়াত। মাঠের পর মাঠ দাপিয়ে, বুনোফুলের ঝাড় পেরিয়ে, বুনোপাখি, পোকামাকড় আর জীবজন্তুদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার মধ্যেই সে খুঁজে বেড়াত জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্তগুলি। মায়ের কাছে থেকে সে শিখেছে, কীভাবে ঝর্ণার মাছেদের সঙ্গে, জঙ্গলের পাখিদের সঙ্গে গল্প করতে হয়। কীভাবে আবিষ্কার করতে হয় প্রকৃতির অনন্য বিস্ময়কে। এক অসাধারণ মেরিন বায়োলজিস্ট হিসেবে ১৯৩৫ সালে র্যাচেল যোগ দিয়েছিলেন ইউএস ব্যুরো অব ফিশারিজ-এ (পরে যা ‘ইউএস ফিশ অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ সার্ভিস’ নামে পরিচিত হয়েছিল)। এটি একটি সরকারি সংস্থা, যার উদ্দেশ্য ছিল বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ। সেখানে কাজ করতে করতেই ১৯৪১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল র্যাচেলের প্রথম বই ‘আন্ডার দ্য সি উইন্ড’। যা তাঁর সাগর, মহাসাগরের প্রাণী নিয়ে গভীর গবেষণার ফল। তাঁর দ্বিতীয় বই ‘দ্য সি আরাউন্ড আস’ ছিল এক বিশাল জনপ্রিয় বই। এই বইটির সাফল্য তাঁকে আর দমিয়ে রাখতে পারেনি। চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্রিয় বিষয় প্রকৃতির ওপরেই লেখালিখিতে মন দিলেন তিনি। বছরের পর বছর ধরে তাঁর বইয়ের জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে মেয়েটি পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে ক্রমশই সচেতন হয়ে উঠছিলেন। তাঁর নজর এড়ায়নি, শহরের কারখানাগুলি নদী আর সমুদ্রে বর্জ্যপদার্থ ফেলে কীভাবে রাসায়নিক কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারে প্রতিদিন মানুষ এবং পরিবেশের ক্ষতি করেই চলেছে। এক নীরব বসন্ত দেখেছিলেন র্যাচেল!
পরিবেশের উপর লেখা র্যাচেলের ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ বইটি তুলে ধরল আমেরিকা সহ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপক হারে ব্যবহৃত এই কীটনাশকের গ্রাস থেকে রক্ষা পায়নি মানুষের বাড়ির অন্দরমহলও। মশা-মাছি, পোকামাকড় মারার জন্য ডিডিটির মতো কীটনাশক স্কুল-রুম থেকে পার্ক, ফার্ম — প্রায় সর্বত্র নির্বিচারে ছড়ানো হচ্ছিল। অথচ এই কীটনাশক শুধুমাত্র পোকামাকড়ই ধ্বংস করছিল না, পাখি, মাছ, বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু এমনকী মানুষের শরীরেরও নানা ক্ষতি করছিল। বইয়ের অষ্টম অধ্যায়ে র্যাচেল লিখেছেন কীভাবে ডিডিটি, হেপ্টাক্লোর, এনড্রিন, ডাইয়েলড্রিন — এসব কীটনাশক ছড়ানোর ফলে গাছপালা, উপকারী কীটপতঙ্গ, এমনকী মাটি ও কেঁচো বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। আর কেঁচোর উপর নির্ভরশীল শত শত পাখি হারিয়ে গিয়েছে কোন কোন এলাকা থেকে। বিষের প্রভাবে হয় তারা মারা পড়েছে দলে দলে, নয়তো তাদের ডিম দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, অথবা ডিম দিয়েছে, কিন্তু বিষের ক্রিয়ায় ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়নি। এভাবে পাখির কলকাকলীতে মুখর আমেরিকার অনেক অঞ্চল পাখিহীন মৃত্যুপুরীর মতো হয়ে গিয়েছিল। এই অধ্যায়টিরই প্রথমে র্যাচেল নাম দিয়েছিলেন ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’। পরে গোটা বইটিরই নাম ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ দিয়ে অধ্যায়টিকে নাম দেন ‘অ্যান্ড নো বার্ডস সিং’। প্রকাশের পরেই বইটি অনেক সেরা বইয়ের তালিকায় স্থান পেয়ে গেল। কেউ কেউ বইটিকে ‘সর্বকালের সেরা পঁচিশ বিজ্ঞানের বই’-এর তালিকায় স্থান দিয়েছেন। যে তালিকায় রয়েছে মহাবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, বিজ্ঞানী আইজাক নিউটন, জোতির্বিদ কোপার্নিকাস, বিবর্তন তত্ত্বের জনক ডারউইনের মতো মনীষীদের লেখা বইগুলো।
এই বইটি পড়ার পরই আমেরিকার মানুষের মধ্যে বড় ধরনের একটি জাগরণ তৈরি হল। মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে এসব বিষাক্ত পদার্থ নির্বিচারে ব্যবহারের বিরুদ্ধে এবং সব ধরণের পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলন শুরু করল। ১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটন ডিসি-তে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির উপস্থিতিতে এক স্পেশাল কমিটির সামনে র্যাচেল পেশ করলেন তাঁর বক্তব্য। তাঁর প্রামাণ্য তথ্যের উপর ভর করে কমিটি কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারে কুফল মেনে নিল। দশ বছর আন্দোলনের পর অবশেষে আমেরিকায় ১৯৭২ সালে ডিডিটির ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করল সরকার। এসব আন্দোলনের ফলেই মার্কিন কংগ্রেস সেদেশে ‘এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সি’ বা পরিবেশ সংরক্ষণ বিভাগ চালু করল। বায়ু, জল, মাটি এসব দূষণ বন্ধ করতে বিভিন্ন আইন জারি করল। যে সব কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান এসব বিষাক্ত দ্রব্য উৎপাদন করত, আগে কখনও পরিবেশ আন্দোলনের ফলে তাদের উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়ার মতো অবস্থায় পড়তে হয়নি। কিন্তু এবারই প্রথম তাদের ব্যবসা রীতিমতো বন্ধ হবার উপক্রম হল। কিন্তু যাঁরা এসব কারখানার মালিক, তাঁরা আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করতে সবসময়ই নারাজ। তাই তাঁরা র্যাচেল কার্সনের বিরুদ্ধে পাল্টা অপপ্রচার চালানো শুরু করলেন। অনেক টাকার বিনিময়ে তাঁরা পত্রিকায় কলাম লেখক থেকে শুরু করে কিছু কিছু লোভী বিজ্ঞানীকে পর্যন্ত হাত করে ফেললেন র্যাচেলের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রকাশ করার জন্য। তাঁদের জোরালো যুক্তি, ডিডিটি দিয়ে কীটপতঙ্গ মারার ফলে কৃষিক্ষেত্রে তথা খাদ্য উৎপাদনে বিপ্লব সাধিত হয়েছে। সেটি ব্যবহার বন্ধ হলে খাদ্যসঙ্কট সৃষ্টি হবে। আর ফলে অপুষ্টিতে অনাহারে প্রচুর লোক মারা যাবে। তাঁরা যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন যে, বৃহত্তর স্বার্থে সামান্য ক্ষতি মেনে নেওয়া উচিত। মানে ডিডিটি ব্যবহার করে পরিবেশের কিছুটা ক্ষতি হলেও লাভ হবে ঢের বেশি। তাছাড়া সেই সময়ে ম্যালেরিয়া রোগের প্রকোপে মৃত্যুর সংখ্যাও ছিল যথেষ্ট। প্রচুর লোক মারা যেত এই ম্যালেরিয়া রোগে। আর সেটি প্রতিরোধের প্রধান হাতিয়ার ছিল এই ডিডিটি। মানুষের মৃত্যুর চেয়ে ক্ষতিকর কিছুই হতে পারে না। তাঁদের দাবি, ডিডিটি উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা মানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ টেনে আনা। কিন্তু, মানুষের আন্দোলন ও বিজ্ঞানের অকাট্য প্রমাণের কাছে তাদের ঠুনকো যুক্তিগুলো খুব বেশিদিন টেকেনি। বলা হয়ে থাকে র্যাচেল কার্সনের ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ বইটিই আমেরিকায় এবং পরে বিশ্বের অন্যান্য দেশে পরিবেশ আন্দোলনের সূচনা করেছিল। স্বভাবতই র্যাচেলকে আজ গোটা দুনিয়া ‘মাদার অব এনভায়রনমেন্টাল মুভমেন্ট’ হিসেবে স্মরণ করে। ১৯৬৪ সালে সেই র্যাচেল কারসনই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ১৯৮০ সালে তাঁকে মরণোত্তর ‘প্রেসিডেনশিয়াল মেডল অব ফ্রিডম’-এ ভূষিত করা হয়।