শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
আসলে কুখ্যাত জঙ্গি মৌলানা মাসুদ আজহারের জয়েশ-ই-মহম্মদের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক ইসলামাবাদের তখতে থাকা পাকিস্তান-ই-ইনসাফ (পিটিআই) এবং তাদের নেতা ইমরান খানের। সেই সম্পর্ক এতটাই মধুর যে আন্তর্জাতিক জঙ্গি অর্থায়নে নজরদারি সংস্থা এফএটিএফ (ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স)-এর কালোতালিকা ভুক্ত করার হুমকি উপেক্ষা করে মাসুদকে মদত দিয়ে যাচ্ছে পাক সরকার। কে না জানে, পাকিস্তানে নির্বাচনের আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে তুলে ধরে লাগাতার প্রচার করে গিয়েছে জয়েশের প্রথম সারির নেতারা। পাশাপাশি ইমরানের জনসভায় ভিড় বাড়ানো থেকে শুরু করে সব রকম সাহায্য করে জঙ্গি সংগঠনটি। ফলে ইমরান খান ক্ষমতায় থাকতে কার সাধ্যি আছে মাসুদ আজহারের টিকি ছোঁয়ার।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি পেশোয়ারে একটি জনসভায় বক্তব্য রাখে মৌলানা। পাক সেনার প্রশংসা করে সে বলে, এককালে উর্দি পরিহিত ভাইরা আমাদের পতাকা খুলে নিত। কিন্তু আজ তারা আমাদের পতাকার নিচেই কদম মিলিয়ে হাঁটছে। মাসুদের বয়ানে স্পষ্ট হয়ে পড়েছে যে খাতায় কলমে জয়েশকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও, পাক সেনাবাহিনীর সমর্থন রয়েছে জঙ্গি সংগঠনটির প্রতি। নিজের ভাষণে মৌলানা সেদিন বলেছিল, গুগলে পুলওয়ামার যে কোনও নাম সার্চ করলেই জয়েশের পতাকা ভেসে উঠবে। কাশ্মীরের ঘরে ঘরে জয়েশের পতাকা পাওয়া যাবে। ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে ওই জঙ্গিনেতা আরও বলে, কাশ্মীর থেকে সেনা সরাতে বাধ্য হবে ভারত। যতদিন তা হচ্ছে না, ততদিন আফজল গুরুর মতো আরও জেহাদি উপত্যকায় প্রবেশ করবে। মৌলানার বক্তব্যের কদিন পরই আত্মঘাতী জঙ্গি হানায় পুলওমায় শহিদ হন ৪৯জন সিআরপিএফ জওয়ান। সব মিলিয়ে পাকিস্তানেই যে হামলার শিকড় তা স্পষ্ট।
একদিকে, পাকিস্তানের ‘জাতীয় সন্ত্রাস-বিরোধী কর্তৃপক্ষে’র ওয়েবসাইটে বলা রয়েছে পাকিস্তানের ৩৩টি বেআইনি জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে একটি জয়েশ-ই-মহম্মদের (জেইএম)। অন্যদিকে, পাঞ্জাব প্রদেশের বাহাওয়ালপুর শহরে ১৬ একর জমির উপর একটি প্রাসাদোপম ভবন গড়ে তুলছে জয়েশ। নাম জামিয়া মসজিদ সুবান আল্লা। দক্ষিণ পাঞ্জাবের গ্রামাঞ্চল থেকে কয়েক হাজার কিশোর যুবককে এনে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকাঠামো থাকছে সেই ভবনে। থাকছে মাটির তলায় একটি চেম্বারও। সেখানে গুলি চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। শুনলে অবাক হবেন, এই ভবন থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে রয়েছে পাক সেনাশিবির। এই মাসুদই নাকি এখন পাক সেনা হাসপাতালে ভর্তি। তার দু’টি কিডনিই বিকল। নিয়মিত ডায়ালিসিস করতে হয়। কার্যত শয্যাশায়ী ষাট ছুঁই ছুঁই মোস্ট ওয়ান্টেড এই জঙ্গি নেতা।
এরপরও পাক বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মহম্মদ ফয়সল বলেছেন, ‘২০০২ থেকে পাকিস্তানে নিষিদ্ধ জয়েশ। সেই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের যা যা করণীয়, তা করা হচ্ছে। অথচ হামলা হওয়ার একটু পরেই কোনও তদন্ত না-করে পাকিস্তানের ঘাড়ে অভিযোগ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ধরনের সাজানো অভিযোগ অতীতেও তোলা হয়েছে।’ এতেই স্পষ্ট, মাসুদ আজহার নিয়ে কে কী অভিযোগ তুলল তাতে ইমরানের কিছু যায় আসে না। ইমরান জানেন, তার পাশে রয়েছে চীন। মাসুদ জানে, চীন তার রক্ষাকবচ। তার মাথার উপর রয়েছে জি জিনপিংয়ের ছাতা। আর তাই, পুলওয়ামায় গাড়িবোমা হামলার পরেও মাসুদ আজহার তথা জয়েশ-ই-মহম্মদের মাথা থেকে হাত সরায়নি বেজিং। কেন জানেন?
এর পিছনে রয়েছে চীন-পাক ইকোনমিক করিডোর। রয়েছে চীনের প্রেসিডেন্ট জি জিনপিংয়ের স্বপ্নের আরও একটি প্রকল্প। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ। যার মাধ্যমে সড়ক, রেল এবং সমুদ্রপথে পরিকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকাকে সংযুক্ত করা হবে। আর চীন-পাক ইকোনমিক করিডোর (সিপেক) পাকিস্তানের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। সিপেক-এর ৪৫টি প্রকল্পে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার লগ্নি করেছে চীনা সংস্থাগুলি। পাকিস্তানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক, এবং জয়েশের মত আইএসআই প্রক্সিদের যদি চীন আন্তর্জাতিক সুরক্ষাকবচ দেয়, তাহলে সিপেক পরিকাঠামোর উপর সন্ত্রাসবাদী হামলা না হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে।
প্রশ্ন হল, কাড়ি কাড়ি টাকা কোথা থেকে পায় মাসুদ? জয়েশের মতো জঙ্গি সংগঠনকে পুঁজি জোগানো বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানকে নির্দেশ দিয়েছিল এফএটিএফ। যার সময়সীমা চলতি বছরের সেপ্টেম্বর। সেটি না হলে বড়সড় নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে হবে পাকিস্তানকে। এ ব্যাপারে ২৬ দফা কর্মসূচির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে ইসলামাবাদ। কিন্তু তারপরেও জয়েশের গাঁয়ে আঁচ লাগে এমন কোনও পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি ইমরান খানকে। উল্টে দেখা গিয়েছে, প্রত্যেক হজযাত্রীকে ১২ হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হয়েছে জয়েশের তহবিলে। এরপরও ইমরান দায় এড়াবেন?
পাক মদতপুষ্ট জয়েশ-ই-মহম্মদের নাড়ির যোগ তালিবানের সঙ্গে। ২০০৩ সালে, পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি পারভেজ মোশারফের বিরুদ্ধে দু’বার প্রাণঘাতী হামলার পর তুঙ্গে ওঠে পাকিস্তান-জয়েশ বিরোধ। এই একই সময় কাশ্মীর উপত্যকাতেও ভিত দুর্বল হতে শুরু করে জয়েশের। এর প্রধান কারণ দু’টি– পাকিস্তানের সমর্থন হারানো, এবং গোষ্ঠীর অভ্যন্তরে ভারতের গুপ্তচরদের অনুপ্রবেশ। ২০১৬ সালে, যে সময়ে কাশ্মীরে প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছিল এবং যার জেরে হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার বুরহান ওয়ানি মারা যায়, সেই সময়ে কুপওয়ারা এবং পুঞ্চ দিয়ে জয়েশের দু’টি গোষ্ঠী ভারতে প্রবেশ করে। নিরাপত্তাবাহিনীর দাবি, কাশ্মীরে জয়েশের সেটাই পুনর্জন্ম। জয়েশের ফের বাড়বৃদ্ধির পিছনে যার হাত সবচেয়ে বেশি রয়েছে বলে মনে করা হয়, সে কাশ্মীর উপত্যকার তিনফুটিয়া জঙ্গি নুর মহম্মদ তান্ত্রে ওরফে নুর ত্রালি। নুর নিহত হয় এই পুলওয়ামাতেই, ২০১৭-র ২৫ ডিসেম্বর। ত্রালির জায়গা নিয়েছিল পাক জঙ্গি মুফতি ওয়াকাস। নূর এবং মুফতি, দুই জঙ্গিই ছিল সদ্যযুবক। একজন ক্লাস টেনের ছাত্র। অন্যজন ট্যাক্সিচালক। মুফতি ওয়াকাস নিহত হয় অবন্তীপোরায়, ২০১৮-র মার্চে। তবুও থেমে থাকেনি হিংসা।
লস্কর এবং হিজবুল মুজাহিদিনের উপর আন্তর্জাতিক নজরদারি থাকায় জয়েশের পুনরুত্থান পাকিস্তানি রণকৌশল বলে মনে করছে গোয়েন্দারা। পাকিস্তানের রাজনীতি-জঙ্গি সংযোগ নিয়ে গবেষণা করছেন জর্জ টাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সি ক্রিস্টিন ফেয়ার। তাঁর দাবি, জয়েশকে যে পাকিস্তান নতুন করে সাজাচ্ছে তার কারণ শুধু আঞ্চলিক কৌশলই নয়, এর পিছনে রয়েছে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কৌশলও। অধ্যাপক ফেয়ার লিখেছেন, জয়েশ হল, পাকিস্তানের একটি কর্মসূচি। যে কর্মসূচির মাধ্যমে পাকিস্তান বিপথগামী জঙ্গিদের নিয়ে আসতে চায় ‘ভালো জঙ্গি’র ছাতার নিচে। একইসঙ্গে যাদের ব্যবহার করে ভারতের সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধও চালিয়ে যাবে।
নিশ্চিত এই অভিযোগ মানতে চাইবেন না ইমরান খান। আর মানলে? নওয়াজের মতো প্রধানমন্ত্রীর পদের ‘ফুটন্ত কড়াই’ থেকে ছিটকে পড়তে হবে তাঁকেও!