শারীরিক দিক থেকে খুব ভালো যাবে না। মনে একটা অজানা আশঙ্কার ভাব থাকবে। আর্থিক দিকটি ... বিশদ
এবার রাশিয়া বিশ্বকাপের আয়োজন করার জন্য মোট ১৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করছে। এই খরচ আগের সব আয়োজনকে টাকার নিরিখে ম্লান করে দেবে। একটু হিসেব দিলেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে। আগের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের মোট খরচ হয়েছিল সাড়ে ১১০০ কোটি ডলার। ২০১০ সালের বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যয় করেছিল সাড়ে ৩০০ কোটি ডলার। এবারের রাজকীয় আয়োজন নিয়ে ছোট্ট একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। যেমন সেন্ট পিটার্সবার্গের ক্রেস্তোভস্কি স্টেডিয়াম। এখানকার কিরোভ স্টেড়িয়ামটি গুঁড়িয়ে ফেলে এই নতুন স্টেডিয়ামটি করা হয়। মোট খরচ হয়েছে ১১০ কোটি ডলার। এটি তৈরির দায়িত্ব পেয়েছিলেন কিশো কুরোকাওয়া। তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আর্কিটেক্ট। সারা বিশ্বে অজস্র অসাধারণ সব নির্মাণ তিনি করেছেন। যেমন টয়োটা স্টেডিয়াম, ওইটা স্টেড়িয়াম, কুয়ালা লামপুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট সহ বিশ্বের একশোটি বড় বড় মিউজিয়াম, ট্রেড সেন্টার, আর্ট সেন্টার তিনি নির্মাণ করেছেন। তবে ক্রেস্তোভস্কি স্টেডিয়ামটি তিনি দেখে যেতে পারনিনি। ২০০৭ সালে স্টেডিয়ামের কাজ শুরু হল এবং সেই বছরই কিশো মারা গেলেন। তবে তাঁর নকশা করা সেই স্টেডিয়ামকে বলা হচ্ছে বিশ্বের সবথেকে আধুনিক। ফিনল্যান্ড উপসাগরের ধারে স্পেসক্র্যাফ্টের আদলে গড়ে ওঠা এই স্টেডিয়ামটির ছাদ এমনিতেই খোলা। কিন্তু দুর্যোগের সময় এর ছাদটি ঢেকে দেওয়া যায়। এই স্টেডিয়ামের ভিতরের তাপমাত্রা সবসময় ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসেই নিয়ন্ত্রণ করা থাকে।
রাশিয়ার মোট ১১টি শহরের যে ১২টি স্টেডিয়ামে খেলা হচ্ছে, সবগুলিই মোটামুটি আধুনিক। কিন্তু ক্রেস্তোভস্কি হল সবার সেরা। যেমন মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়াম অনেক পুরনো। আগে এর নাম ছিল সেন্ট্রাল লেনিন স্টেডিয়াম। সংস্কারের পর নতুন নামকরণ হয়েছে লুঝনিকি। মস্কোভার নদীর জলে এই স্থান একসময় প্লাবিত হয়ে যেত। জল সরে গেলে সেখানকার পলিমাটিতে গজিয়ে উঠত ছোট ছোট ঘাস। তাই স্টেড়িয়ামের নতুন নামকরণ করা হয়েছে লুঝনিকি। যার মানে হল তৃণভূমি।
খেলার আসরের পাশাপাশি অন্য দেশ থেকে আগত পাঁচ লক্ষেরও বেশি পর্যটকের বেড়ানোর জন্য নানা রকম ব্যবস্থা করেছে রুশ সরকার। সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, পুতিন নিজেই সব ব্যাপারটা দেখভাল করছেন। আইএসআইএসের হামলার একটা আশঙ্কার কথা আগে থেকেই ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই পুরো ব্যবস্থাকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মোড়কে রাখতে মরিয়া পুতিন। একটা জঙ্গি মাছিও যেন পর্যটকদের কোনও ক্ষতি করতে না পেরে তার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা চলছে। নিরাপত্তার খাতেই ব্যয় হচ্ছে পাঁচশো কোটি ডলারের বেশি।
নিরাপত্তার ঘেরাটোপে স্বচ্ছন্দে যাতে পর্যটকরা ঘুরে বেড়াতে পারেন, তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন পুতিন। মস্কো শহরে আছে চারশোর বেশি নানা ধরনের মিউজিয়াম, আছে ঘুরে বেড়ানো, রিভার ক্রুজ, বলশয়, ব্যালে, থিয়েটার এবং নানা ঐতিহাসিক স্থান। রাশিয়ার একটা নিজস্ব দীর্ঘ ইতিহাস আছে। আছে তার বিপ্লব। তার সাহিত্য ও সংস্কৃতি। জারের আমল, তার বৈভব পেরিয়ে এক দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে রাশিয়া। রাজনীতির লেনিন, স্তালিন থেকে সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের তলস্তয়, গোর্কি, গোগোল, দস্তয়েভস্কি, চেকভ, স্তানিস্লাভস্কি, তারকোভস্কি সহ আরও কত মানুষ। আছেন বিশ্বখ্যাত লেভ ইয়াসিন, দাসায়েভ প্রমুখ। খেলা দেখার পাশাপাশি রয়েছে রাশিয়ার ইতিহাস, সমাজ এবং মনীষীদের সঙ্গে পরিচয় করা। তাঁদের জানা। তার জন্য সব রকমের আয়োজন করা হয়েছে। এমনিতে রুশরা খুব একটা ইংরেজি জানেন না। তাতে তাঁরা বিশেষ পরোয়াও করেন না। কিন্তু বিদেশি পর্যটকদের কথা ভেবে প্রচুর ইংরেজি জানা স্বেচ্ছাসেবক রাখা হয়েছে। যাঁরা নানাভাবে পর্যটকদের সাহায্য করবেন। দীর্ঘদিন ধরে সরকার এঁদের ট্রেনিং দিয়েছে। বিশ্বকাপ শুরুর আগে জাতীয় দলকে শুভেচ্ছা জানানোর সময় পুতিন বলেছিলেন, বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে আমরা প্রচুর টাকা ব্যয় করেছি। সারা বিশ্ব আজ রাশিয়ার দিকে তাকিয়ে। একে কেন্দ্র করে খেলাধুলোর যে পরিকাঠামো তৈরি হল, তার জন্য রাশিয়া আগামী দিনে গর্ব অনুভব করবে।
তবে দেশের ভিতর থেকেই কিন্তু একটা প্রশ্ন উঠে আসছে। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, এই যে পুতিন দেশের ভাণ্ডার থেকে জলের মতো টাকা খরচ করে গেলেন, সে সব টাকা ফিরে আসবে তো? অর্থাৎ এই বিশ্বকাপের আসর রাশিয়াকে আর্থিক দিক থেকে কতটা ফিডব্যাক দিতে পারে! কিছু অর্থনীতিবিদ হিসেব কষে দেখিয়েছেন, লাভ তো দূরের কথা, মোট ব্যয়ের টাকাই উঠবে না। মেরে কেটে ৮০০ থেকে ৯০০ ডলার রাশিয়ার ভাণ্ডারে আসবে। সুতরাং দেশের পক্ষে এটা এক বিরাট ক্ষতি। একেই দেশের অর্থনীতি ডেফিসিটে চলছে, তার উপর এই খাঁড়ার ঘা। দেশের জনগণের উপর এই কাপ না অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য দেশের মানুষ এই সব নিন্দুকের কথায় এখনই কান পাতছেন না। তাঁরা এখন স্বপ্নে বুঁদ হয়ে আছেন। একটা মাস তাঁরা এক উন্মাদনার মধ্য দিয়ে কাটাবেন। একটা রঙিন জগতের ভিতর যেন ঢুকে পড়া। মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ। সোচি থেকে সামারা, কিংবা কাজান থেকে কালিনিনগ্রাদ। সর্বত্রই এখন এক ছবি। বারবার তো এমন সুযোগ আসে না।
সত্যিই তো বারবার তো এমন সুযোগ আসে না, আমরাও কয়েকটা দিন হাঁ করে গোগ্রাসে গিলে নিই রূপকথার রূপ, রস, গন্ধটুকু।
ছবি: হাম্বির বিশ্বাস