সমৃদ্ধ দত্ত, নয়াদিল্লি, ৯ ডিসেম্বর: বিরোধীদের প্রবল প্রতিবাদ, হইচই এবং বাগবিতণ্ডার মধ্যেই লোকসভায় ভোটাভুটিতে ৩১১-৮০ ব্যবধানে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ করিয়ে নিল মোদি সরকার। রাত তখন ১২টা বেজে গিয়েছে। আজ লোকসভায় আলোচনা ও ভোটাভুটিতে সংযুক্ত জনতা দল, বিজু জনতা দল, শিবসেনা, এআইডিএমকে তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি ইত্যাদি এনডিএর বাইরে থাকা দলগুলিও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলকে সমর্থন করেছে। সুতরাং বার্তা স্পষ্ট, এই দলগুলির সমর্থন পেয়ে রাজ্যসভায় বিল অনুমোদনের পক্ষে সংখ্যা জোগাড় করে নেওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, খ্রিস্টান, পার্সি সম্প্রদায়ের তাবৎ ধর্মের বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের কাছে বৈধ কোনও নথি না থাকলেও, প্রত্যেককে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। অর্থাৎ দেওয়া হবে না শুধুমাত্র মুসলিমদের। ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের পরে কেউ ভারতে এলে অবশ্য হিন্দু হলেও তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। সরকার এই ব্যাপারে একটি এজেন্সি গঠন করবে। সেই এজেন্সি ঠিক করবে কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তর এবং সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কারা নাগরিকত্ব সংক্রান্ত সার্টিফিকেট প্রদান করতে পারবে। ১৯৪৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে যত হিন্দু ও অন্য অমুসলিম ধর্মাবলম্বীরা ভারতে এসেছেন এবং যাঁদের কাছে নাগরিকত্ব-নথি নেই, তাঁরা একটি আবেদনপত্র পূরণ করে নির্দিষ্ট এজেন্সির কাছে জমা দেবে। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব বিলে বলা হয়েছিল, ১১ বছর থাকতে হবে ভারতের নাগরিকত্ব পেতে হলে। সেই ৫ নং ধারার সংশোধন করে নয়া সংশোধনী বিলে বলা হয়েছে, ১১ বছরের পরিবর্তে ৫ বছর ভারতে থাকার প্রমাণ দিলেই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। যদিও বিলে স্পষ্ট বলা হয়নি যে, কারা ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে এসেছে তা প্রমাণ করা যাবে কীভাবে! অর্থাৎ কেউ যদি তার পরেও আসে এবং নাগরিকত্বের আবেদন করে, তাহলে সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হবে কি না, অথবা কিসের ভিত্তিতে খারিজ হবে, তা বলা হয়নি বিলে। আজ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পেশ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অমুসলিমদের উদ্দেশে বলেছেন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। রেশন কার্ড বা অন্য কোনও নথি না থাকলেও আমরা আপনাদের নাগরিকত্ব দেব। তিনি আরও বলেন, এই বিলের বিরোধিতা করছে কংগ্রেস। কিন্তু কেন এই আইন আনতে হয়েছে? কারণ একটাই। কংগ্রেস ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ করেছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই মন্তব্যের প্রবল বিরোধিতা করে কংগ্রেস। কংগ্রেস নেতা মনীশ তিওয়ারি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ইতিহাসের জ্ঞান থাকা দরকার। ১৯৩৫ সালে আমেদাবাদে সর্বপ্রথম ধর্মের ভিত্তিতে ভারতের বিভাজনের কথা বলেছিলেন হিন্দু মহাসভার নেতা দামোদর সাভারকর।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিরোধী দলগুলি প্রশ্ন করেছে, বেছে বেছে কেন শুধুই পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান? কেন নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার থেকে আগত বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের কথা বলা হয়নি? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যেহেতু এই তিন রাষ্ট্রই ইসলামিক দেশ, তাই এই দেশগুলিতে অন্য সংখ্যালঘুদের উপর অকথ্য অত্যাচার করা হয়েছে। সেই সংখ্যালঘুদের আশ্রয় দেওয়া আমাদের কর্তব্য। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আজ বলেছেন, ভারতের সঙ্গে ১০৬ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে আফগানিস্তানের। তাঁকে বিরোধীরা বলে, আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের কোথায় সীমান্ত রয়েছে? অমিত শাহ জবাবে বলেন, পাক অধিকৃত কাশ্মীর কি ভারতের অঙ্গ নয়? তার সঙ্গে তো আফগানিস্তানের সীমান্ত আছে! নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরোধিতা করে এদিন সংসদেই হায়দরাবাদের এমপি তথা এআইএমআইএম নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি ওই বিলের কপি ছিঁড়ে ফেলেন। তঁাকে কক্ষ ত্যাগ করার নির্দেশ দেন স্পিকার। তাতে অবশ্য বিরোধিতা কমেনি। তৃণমূল এমপি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বিজেপি মুখে স্বামীজি, বল্লভভাই প্যাটেলের কথা বলে। কিন্তু তঁাদের আদর্শ মানে না। তঁার আক্রমণ, ঘুরপথে যতই চেষ্টা করুন পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি হতে আমরা দেব না।
রাতে প্রতিটি প্রশ্নের ধরে ধরে উত্তর দিতে শুরু করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর এক ঘণ্টার ভাষণে বারেবারে বিরোধীদের হইচই থামানোর চেষ্টা করেন স্পিকার। কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় অমিত শাহ বলে ওঠেন, একটু ধৈর্য্য ধরুন না! সব বলব। রাজনৈতিক ভেদাভেদ, ভোটব্যাঙ্কের জন্য যদি আপনারা চোখ-কান বন্ধ করে রাখেন, অনুরোধ করছি, তা খুলে ফেলুন। দেশের স্বার্থে। সংবিধানই হল মোদি সরকারের একমাত্র ধর্ম।