বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
কাটা দুধের প্যাকেট দেখিয়ে চা বিক্রেতার জবাব, ‘নেহি আয়া।’ সঙ্গে সঙ্গে তরুণীর হাতে ফোন, শোনা গেল কথা, ‘সামান কে লিয়ে আয়া...।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই মাটিগাড়ার পরিবহণনগরের ওই দোকানে হাজির হল এক যুবক। গাল ভাঙা। রং কালো। হাতে দুধের প্যাকেট। তরুণী ও যুবক, দু’জনেই চায়ের দোকান থেকে কিছুটা দূরে গাছতলায় গেল। এরপর অন্তর্বাসে কিছু একটা গুঁজে জাতীয় সড়কের দিকে এগল তরুণী। যুবক খালি হাতে ফিরল দোকানে। পকেট থেকে বেরল ১০০ টাকার নোট। গুঁজে দিল চা বিক্রেতার হাতে।
‘এই সামান আসলে কী দাদা?’ চাওয়ালা নির্বিকার, নিরুত্তর। আপন মনে কাপ ধুচ্ছেন। দু’কাপ চায়ের সঙ্গে বেকারির বিস্কুট খেয়ে আবার সেই প্রশ্ন। এদিক-ওদিক তাকিয়ে মুচকি হেসে তাঁর উত্তর, ‘আরে দাদা, সোনার চেয়েও বেশি দামি সামান। বুকে গুঁজে এক গ্রাম নিয়ে গিয়ে বিক্রি করলেই তরুণী পাবে কড়কড়ে ৩০০০ টাকা।’ স্তম্ভিত হওয়ার মতো বিষয় নয়। কারণ এই ‘সামান’ হল ব্রাউন সুগার। আর এই এলাকা? মাদক কারবারের ‘সেফ হোম’।
একইভাবে মাটিগাড়ার খাপরাইল মোড়, পাথরঘাটা, সুটকি কলোনি, বিশ্বাস কলোনিতেও চলছে মাদকের রমরমা কারবার। ইদানীং মহিলাদের আনাগোনা বেড়েছে। মাদক পাচার থেকে বিক্রি, সবই করছেন সুন্দরীরা। সেরকমই একজন বলছিলেন, ‘কয়েক মাস আগে সামান পাচারের অভিযোগে পুলিস গ্রেপ্তার করেছে স্বামীকে। ছাড়ানোর জন্য উকিলবাবুরা প্রচুর টাকা চাইছেন। পুলিসও মাঝেমধ্যে বাড়িতে আসছে। ছেলেমেয়ে নিয়ে আর সংসার চলে না। তাই সামান বিক্রি ছাড়া উপায় নেই।’
একটা পুরিয়ায় কতটা ব্রাউন সুগার থাকে? মহিলা বলেন, ‘দুটো দেশলাই কাঠির আগায় যতটা ওঠে, ততটাই। হোমিওপ্যাথি ওষুধের মতো পুরিয়া। দাম ৫০ থেকে ১০০ টাকা। একগ্রাম বিক্রি করলেই ৩ হাজার টাকা। আর ১০০ গ্রাম বিক্রি করতে পারলে লাখের উপর।’
শুধু মাটিগাড়া নয়, এ ধরনের কারবারের ঠেক এনজেপি, প্রধাননগর, ভক্তিনগর, নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি এলাকাতেও গজিয়ে উঠেছে। কিছু জায়গায় মহিলারা নিজস্ব গ্যাং তৈরি করেছেন। এনজেপি থানার ফুলবাড়িতে সেই গ্যাংয়েরই একজনের সঙ্গে দেখা। ইনি ক্যারিয়ার। প্রথমে মুখ খুলতে রাজি না হলেও পরে জানালেন, স্বামীর দেওয়া একটা নম্বরে ফোন করার পর বাড়িতেই পৌঁছে যায় ‘পাতার’ প্যাকেট। সিন্ডিকেটের মাথাদের কথা মতো তা কখনও এনজেপি থেকে ভক্তিনগর, আবার কখনও ইসলামপুর থেকে মাটিগাড়া, আবার কখনও দার্জিলিং পাহাড়ে সাপ্লাই করতে হয়। খাবারের প্যাকেট, স্যানিটারি ন্যাপকিন, দুধের প্যাকেটে লুকিয়ে। মেলে কমিশন। ব্রাউন সুগারের কোডনেম ‘পাতা’। আর পাসওয়ার্ড ‘চিরকুট’।
এ তো গেল কারবারের ‘লেডি গ্যাংয়ের’ কথা। কিন্তু, কোথা থেকে কীভাবে এখানে আসছে মাদক? এর নেপথ্যে রয়েছে মুর্শিদাবাদের মাদক মাফিয়ারা। ওই জেলার রঘুনাথগঞ্জ, লালগোলা, নদীয়ার করিমগঞ্জ, মালদহের কালিয়াচক, বৈষ্ণবনগর, গাজোল প্রভৃতি এলাকা থেকে সড়ক পথে হেরোইন এখানে আসছে। মাছ, আম ও সব্জির গাড়িতে লুকিয়ে আনা হচ্ছে। কখনও ফেরিওয়ালার ছদ্মবেশ নিচ্ছে কারবারিরা। মুর্শিদাবাদে হেরোইনের কোডনেম ‘আঠা ও পানি’। এখানে স্থান ভেদে হেরোইনের কোডনেম আলাদা। কোথাও সামান, কোথাও পাতা, কোথাও আবার পাউডার বা বিএস। আর ডেলিভারির জায়গা? শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহারের বিভিন্ন এলাকা।
মালদহ ও মুর্শিদাবাদে পোস্ত খেত ধ্বংসের পর কারবারিরা নতুন পন্থা নিয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর থেকে পোস্ত ফলের আঠা ট্রেনে যায় মালদহ ও মুর্শিদাবাদে। সেখানেই কেমিক্যাল মিশিয়ে প্রস্তুত হয় হেরোইন ও ব্রাউন সুগার। এরপর তা শিলিগুড়ি হয়ে পাচার হয়ে যায় দার্জিলিং, কালিম্পং, সিকিম ও নেপালে। আর এই চক্রে চোখে ধুলো দেওয়ার কাজ? লেডি গ্যাং আছে তো!