সেন্টু: হিন্দু মতে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর—এই তিন পুরুষের উপরই পৃথিবী দাঁড়িয়ে। মহেশ্বর প্রলয়কারী হলেও সৃষ্টির দেবতা কিন্তু ব্রহ্মা। আর নারায়ণ পালনকর্তা। অথচ, সব ভুলে শিবপুরের দেবনাথ পরিবার তাদের সৃষ্টিশীল পুত্রের নাম রাখেন নারায়ণ। সুদর্শন দেবসুলভ চেহারা যেমন, তেমনই তাঁর ব্যক্তিত্ব। রাশভারী নয়, কিন্তু বড্ড চাপা। সবার কাছে কিছুতেই মিলেমেশে যেতে পারতেন না। চাইতেন একটু মনের মিল। তেমনটা হলেই কেয়াবাত। ভালোলাগার সেই মানুষগুলোর সঙ্গে তাঁর জমিয়ে আড্ডা ছিল মনে রাখার মতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত...। সে ছিল নয়ের দশকের শুরুর কথা। আমি তখন সবে ‘বর্তমান’-এ কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। তখন একটা চ্যানেল থেকে আলোচনায় বসার ডাক এল। বাংলার কার্টুনিস্টদের নিয়ে কথা। বাংলা চ্যানেলের তখন তেমন এতটা রমরমা ছিল না। আমি শ্রদ্ধেয় চণ্ডী লাহিড়ী, রেবতীভূষণকে রাজি করতে পারলেও নারায়ণ দেবনাথকে কিছুতেই পারছিলাম না। অনেক কষ্টে ঠিকানা জোগাড় করে শিবপুরের ওই গলি বেয়ে যখন বাড়িতে পৌঁছলাম, তখন দুপুর দু’টো। দেখি, বসার ঘরের কোণায় একটা চেয়ারে বসে আমার ছেলেবেলার হিরো। পরনে বাটিক প্রিন্টের লুঙ্গি, আর একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। পরিপাটি করে ব্যাকব্রাশ করা ঘাড় পর্যন্ত উপচে পড়া সাদাকালো চুল। ওই চুলই ছিল ছ’ফুট লম্বা লোকটার আকর্ষণ। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত অবিকল ছিল ওঁর সেই চুল। সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি এত চুল ভালোবাসেন, অথচ আপনার চরিত্রগুলোর মাথায় এত কম চুল কেন?’ মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘আমি তো ওদের সব দিয়েছি। সংসারের অনটন বুঝতে দিইনি... টাকা ছিল না বলে বাসে না উঠে হেঁটে কলেজ স্ট্রিট গিয়েছি। কত স্বর্ণালি বিকেল-সন্ধে শুধু ওদের সৃষ্টিতেই মেতে থেকেছি। কোনওদিন বুঝতে দিইনি আমার কষ্ট... আমার মান... অভিমান। সব দিয়েছি। শুধু এইটুকু রেখেছি নিজের জন্য। কি... ভুল করেছি?’ হাসতে হাসতে বললাম, ‘একদম না।’ চেয়ার থেকে উঠে ধীর পায়ে আমার খুব কাছে এগিয়ে এসে বললেন, ‘ভাই আমি তো রাজনীতির কিছুই বুঝি না... আমি কি এই আলোচনার যোগ্য?’ বলেছিলাম, ‘আপনি রাজনীতি বুঝুন আর না বুঝুন, বাংলার মানুষের কাছে আপনার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি।’ আলতো কিন্তু বেশ মিষ্টি করে বললেন, ‘তুমি ভুল করছ... আমি নই, যা পরিচিতি সবটাই ওই বাঁটুল, নন্টে-ফন্টে, আর হাঁদা-ভোঁদার।’ আজ মনে হচ্ছে এ কথাটা কতটা সত্যি। আর একজন শিল্পী হিসেবে এটা যে কত বড় প্রাপ্তি, তা একমাত্র আর একজন শিল্পীই বোঝে।
আর একদিনের কথা খুব মনে পড়ছে। ফোন এসেছিল শান্তনুর। ওঁর ছেলের মতো। বেশ অসহায় গলা। নারায়ণ দেবনাথ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। খুব অসুস্থ। কোথাও একটা ভর্তি করতেই হবে। কী করব, কিছু ভেবে না পেয়ে সরাসরি ফোন করেছিলাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সত্যি বলতে, আমি নিজেও ভাবিনি মুখ্যমন্ত্রী এত দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন। হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসার সব খরচ সরকার তুলে নিয়েছিল কাঁধে। এমনকী মাসিক ভাতার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন দিদি। সেই যাই হোক, বিকেলে ফোন পেলাম দিদির। বললেন, ‘তোর বাঁটুলদাকে বেলভিউতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি।’ দিদি হয়তো মজা করে বলেছিলেন... সারা বাংলা নারায়ণ দেবনাথকে নাও চিনতে পারে... কিন্তু এরাজ্যে এমন একজনও নেই, যে বাঁটুলকে চেনে না, হাঁদা-ভোঁদার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যে পরিচিত নয়... বা নন্টে-ফন্টের সঙ্গে কেল্টুদার নারদ-নারদ দেখেনি। তারাই যে আমাদের শৈশব। নন্টে বা হাঁদার মধ্যে আমরা আমাদের স্কুলবেলা দেখতে পাই। আর বাঁটুল দি গ্রেট... একমাত্র বাঙালি সুপারহিরো। নাঃ... সুপারহিরো একজনই। তাঁর নাম নারায়ণ দেবনাথ। তাঁর কলম থামল। কিন্তু সেই কলম থেকে গেল স্মৃতিতে। অমর হয়ে। ইতিহাস হয়ে।