বাপ্পাদিত্য রায়চৌধুরী, কলকাতা: হরিদেবপুরের সন্তোষ চট্টোপাধ্যায় ই-কমার্স সংস্থা থেকে একজোড়া জুতো কিনেছিলেন। সেই জুতো জুতসই না হওয়ায়, তিনি তা ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নেন। কলসেন্টারে ফোন করে জুতো ফেরত দিতে চাইলে, অপর প্রান্ত থেকে তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য চাওয়া হয়। সেই তথ্য দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সন্তোষবাবু দেখেন, তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে ৩০ হাজার টাকা গায়েব হয়ে গিয়েছে। দিনেদুপুরে ডাকাতির নিষ্পত্তি করতে অবশেষে পুলিসের কাছে যান তিনি। 
সন্তোষবাবুর টাকা খোয়া যাওয়া কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। কলকাতা বা বাংলা তো বটেই, দেশের আনাচে-কানাচে ক্রমেই বাড়ছে ডিজিটাল লেনদেন সংক্রান্ত প্রতারণা। হিসেব বলছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণের মতোই লাগামহীনভাবে বেড়েছে আর্থিক প্রতারণা। ডিজিটাল লেনদেন যত বেড়েছে, ততই জাঁকিয়ে বসেছে জালিয়াতি। গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে যত আর্থিক প্রতারণা হয়েছে, তার তুলনায় জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রতারণা বেড়েছে ৮৯ শতাংশ। ঋণ সংক্রান্ত স্কোর প্রদানকারী দেশের অন্যতম সংস্থা ‘ট্রান্সইউনিয়ন সিবিল’ এই তথ্য জানাচ্ছে। পাশাপাশি অপর একটি সংস্থার সমীক্ষা জানাচ্ছে, গত এক বছরে ডিজিটাল লেনদেনে আর্থিক প্রতারণা বেড়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ। 
করোনাকালে কতটা বেড়েছে ডিজিটাল লেনদেন? ন্যাশনাল পেমেন্টস কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার তথ্য বলছে, চলতি বছরের গোড়ায়, অর্থাৎ জানুয়ারিতে দেশে ৩৭২.৮ কোটি সংখ্যক ডিজিটাল লেনদেন হয়েছে। আর্থিক বছরের গোড়ায়, অর্থাৎ এপ্রিলে তা হয় ৪৪৭.৪ কোটি। মে মাসে তা সামান্য কমে হয় ৪১৪.৬ কোটি। জুনে ৪৬১.৭ কোটি। মে মাসে যেখানে মোট ১৪ লক্ষ ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল, তা জুনে পৌঁছয় ১৫ লক্ষ ১৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকায়। অর্থাৎ সার্বিকভাবে দেশে অনেকটাই বেড়েছে ডিজিটাল লেনদেন।  
আসা যাক প্রতারণার কথায়। ট্রান্সইউনিয়ন সিবিলের হিসেব বলছে, গত বছরের শেষ চার মাসের তুলনায় এই বছরের প্রথম চার মাসে আর্থিক ক্ষেত্রে প্রতারণা বেড়েছে ৮৮.৫ শতাংশ। তবে সিবিলের বক্তব্য, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের তুলনায় ভারতে আর্থিক জালিয়াতির হার কম। কারণ সেখানে ইতিমধ্যেই তা ১০০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য আর্থিক সংস্থায় প্রযুক্তিগত সহায়তা সংস্থা এফআইএস জানাচ্ছে, দেশে গত এক বছরে লেনদেন সংক্রান্ত জালিয়াতির শিকার ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। গত বছর জুন থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত করা সমীক্ষা বলছে, এদেশের ক্রেতাদের ৬৮ শতাংশ ডিজিটাল পেমেন্ট বা মোবাইল পেমেন্টে অভ্যস্ত হয়েছেন। আর সেই পথেই জাল পেতেছে জালিয়াতরা। দেশে দু’হাজারের বেশি মানুষের উপর সমীক্ষা চালায় এই সংস্থা। সেখানে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি জালিয়াতি হয়েছে ইমেল বা মেসেজের মাধ্যমে। অর্থাৎ কোনও একটি ‘লিঙ্ক’ পাঠিয়ে, সেটি থেকে কোনও ব্যক্তির তথ্য ও টাকা হাতিয়ে নেওয়ার হার ১৮ শতাংশ। এরপর রয়েছে কিউআর বা ইউপিআই’য়ের মাধ্যমে জালিয়াতি। ক্রেডিট কার্ড ও ডেবিট কার্ড জালিয়াতির হার ১১ শতাংশ। করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত তথ্য দেওয়ার নামে টাকা হাতানোর হার এক শতাংশ, বলছে সমীক্ষা। ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সিরাই সবচেয়ে বেশি আর্থিক প্রতারণা বা জালিয়াতির শিকার হয়েছেন, বলছে ওই আন্তর্জাতিক সংস্থার সমীক্ষা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ যত বেশি ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন, সামান্য অসাবধানতার সুযোগ নিয়ে ততই বাড়বে জালিয়াতি। প্রযুক্তিভিত্তিক সেইসব প্রতারণার বিরুদ্ধে সব সময় লড়াই করাও কঠিন, বলছেন তাঁরা।