শুভ্র চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা: কয়লা মাফিয়া অনুপ মাঝি তথা লালার কালো কারবারের জোরালো সূত্র মিলেছিল মার্চ মাসেই। বিশ্বস্ত সূত্রে বেআইনি কয়লার খোঁজে ঝাড়খণ্ডে হানা দিয়ে সিবিআই আধিকারিকরা আটক করা একটি লরির চালকের কাছ থেকে একটি ১০ টাকার নোট উদ্ধার করেন। সেই নোটের নিচে থাকা সিরিয়াল নম্বরই ছিল পাচারের সাংকেতিক চিহ্ন। সেই চিহ্ন দেখালেই বেআইনি কয়লা নিয়ে অবাধ যাতায়াতের ছাড়পত্র মিলত। সিবিআই আধিকারিকরা বেআইনিভাবে কয়লা পাচার করা লরির চালক ও খালাসিদের জেরা করে জানতে পারেন, ১০ ছাড়াও ৫, ৫০ এবং ১০০ টাকার নোটও এই বেআইনি কাজ মসৃণভাবে সারতে দিনের পর দিন কাজে লাগানো হয়েছে। রোজ এক-একটি টাকার অঙ্কের নোট ব্যবহার করা হয়। কিন্তু নোটগুলি যায় কোথায়? সিবিআই সূত্রের খবর, নোট থাকে লরির চালকের হাতে। সঙ্গে থাকে রোড চালান। তার উপরে লেখা থাকে সেই বিশেষ নোটের সিরিয়াল নম্বর। এই চালানের ফটোকপি চলে যায় দুর্গাপুর, আসানসোল, রানীগঞ্জ সহ যে যে থানা এলাকা দিয়ে অবৈধ কয়লা যাবে, সেইসব জায়গায়। বিভিন্ন চেক পোস্ট-এর দায়িত্বে থাকা পরিবহণ ও সেলস ট্যাক্স দপ্তরের কর্তাদের কাছেও। লরি এলে চালক সেই নোট দেখান। সিরিয়াল নম্বর মিলিয়ে দেখা হয়। মিলে গেলে ওই চক্রে যুক্ত অফিসাররাও বুঝে যান এটা আসলে ‘লালার লরি’। কয়লা পাচারের এই ‘চেন’ চালাতে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, দ্রুত তাতে হস্তক্ষেপ করতেন বিভিন্ন প্রভাবশালীরা। তবে কবে কোন নোট যাবে, সেই সিদ্ধান্ত লালারই। ফোন করে সব থানা, চেক পোস্ট, ডিউটিতে থাকা অফিসারদের জানিয়ে দেওয়া হত লরি আসার কথা। তাদের সঙ্গে কথোপকথনের ‘কল লিস্ট’ও হাতে চলে এসেছে সিবিআই- এর কাছে। কারা যোগাযোগ রাখত, সেই নামের তালিকাও পাওয়া গিয়েছে।
এক পদস্থ সিবিআই আধিকারিক জানান, কিছুদিন আগে ঝাড়খন্ড-বিহার সীমানায় একটি কয়লা বোঝাই লরি আটক করে সিবিআই। তাতে অবৈধ খাদানের কয়লা ছিল। চালক টাকা ও সিরিয়াল নম্বর দেখান। জেরা করা হয় তাকে। জানতে চাওয়া হয় এটা কীসের নম্বর। বলে, এ টাকা লালার দেওয়া। কেউ ধরলে বলবে—‘লালাবাবুর টাকা’। সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেবে। বাজেয়াপ্ত করা হয় সেই নোট। তারই সূত্র খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, এই টাকার সাংকেতিক চিহ্নে চলছে কোটি কোটি টাকার কয়লা কারবার। এও জানা যায়, ঝাড়খণ্ডে প্রচুর অবৈধ কয়লা খাদানের কয়লা আসছে এভাবে। খোঁজখবর শুরু করে সিবিআই। জানা যায়, এগুলি সব লালার লরি। তারই কয়লা।
সিবিআই সূত্রের খবর, অন্যান্য কয়লা চোরদের লালাকে ‘গুন্ডা ট্যাক্স’ দিতে হতো। তারা বৈধ খাদান থেকে কয়লা চুরি করতো। তাদের লরিতে মাল পাঠানোর ব্যবস্থা করা, পুলিস, নেতা, চেক পোস্ট-এর অফিসার—সব সেটিং করিয়ে দিত লালা। নিজের কয়লা ছাড়া তাদের কয়লাও পাচার করিয়ে দিত। লরিপিছু নিত ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। ভাগও যেত ওই কয়লা মাফিয়ার বশে থাকা পুলিস, নেতা, চেক পোষ্টের দায়িত্বে থাকা আধিকারিকদের সিন্ডিকেটের কাছে। লালার এই সিন্ডিকেট ঝাড়খন্ডে চলত সেখানকার এক বড় মাফিয়ার হাত ধরে। তার মাধ্যমে কয়লা পাচার হত ঝাড়খন্ড, উত্তরপ্রদেশ সহ অন্যান্য জায়গায়। লালাকে তলব করা হচ্ছে শীঘ্রই। এমনই জানা গিয়েছে সিবিআই সূত্রে।