নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: কালো টাকা! তাও আবার খোদ আয়কর শীর্ষ কর্তার। এক ব্যবসায়ীর মদতে চলছিল সেই টাকা সাদা করার কারবার। এমনই চাঞ্চল্যকর অভিযোগের তদন্তে ক্রমশ জাল গুটিয়ে আনছে কলকাতা পুলিস। শনিবারই গ্রেপ্তার করা হয়েছে আয়কর কর্তার প্রধান সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত এক চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফার্মের মালিককে। ধৃতের নাম গোবিন্দ আগরওয়াল। কলকাতা পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগের জালিয়াতি দমন শাখার নজরে এবার নীরজ কুমার সিং। আয়কর দপ্তরের সেই পূর্বতন ডেপুটি ডিরেক্টর। রোজভ্যালি চিটফান্ড কেলেঙ্কারিরও নাম জড়িয়ে রয়েছে তাঁর সঙ্গে।
ভুয়ো সংস্থার মাধ্যমেই চলত কালো টাকা সাদা করার এই চক্র। এই দু’জনের বিরুদ্ধে তিন বছর আগেই দুর্নীতি দমন, প্রতারণার অভিযোগে এফআইআর দায়ের করেছিল কলকাতা পুলিস। সেই মামলায় গতকাল ওই ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করতে ডালহৌসির ম্যাঙ্গো লেনে পৌঁছে যান তদন্তকারীরা। সেই সময় অফিস থেকে বেরচ্ছিলেন গোবিন্দ আগরওয়াল। রাস্তায় গাড়ি আটকায় পুলিস। রাতেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। রবিবার ব্যাঙ্কশাল আদালত ব্যবসায়ীকে দু’দিনের জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
চার বছর আগেই এই চক্রের খোঁজ পায় কলকাতা পুলিস। নোট বাতিলের ঠিক পরে। তখন কলকাতায় কর্তব্যরত ছিলেন নীরজ। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ওই ম্যাঙ্গো লেনেরই একটি অফিস থেকে ১ কোটি ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করে পুলিস। সবই পাঁচশো এবং হাজার টাকার বাতিল নোট। প্রদীপ রায়, সন্দীপ ঘোষ এবং অরুণ সিং নামে তিন ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের জেরা করেই সামনে আসে গোবিন্দ এবং ১৯৯৪ ব্যাচের আইআরএস অফিসার নীরজের নাম।
ওই অফিসে তল্লাশি চালিয়ে উঠে আসে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। তদন্তে জানা যায়, এই সংস্থার মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করা হয়। তার মালিক গোবিন্দ আগরওয়াল। যার মূল কাজ, কমিশনের বিনিময়ে বাতিল নোট নিয়ে কড়কড়ে দু’হাজার এবং পাঁচশো পাইয়ে দেওয়া। ওই চার্টার্ড ফার্ম ছাড়াও একাধিক ‘শেল’ কোম্পানির হদিশ মেলে। চাকর, গাড়ির চালক, পিয়ন, মুটে এমন অনেকের নামে প্রায় ১০০ কোম্পানি খুলেছিল গোবিন্দ। যেগুলিকে এই কালো টাকা সাদা করার কাজে ব্যবহার করা হতো। আর সেই কাজে সাহায্যকারী হিসেবে প্রকাশ্যে চলে আসে আয়কর কর্তার যোগ। এব্যাপারে বিভিন্ন নথি হাতে আসার পর ২০১৭ সালের ৫ মে হেয়ার স্ট্রিট থানায় দু’জনের নামে মামলা দায়ের করে জালিয়াতি দমন শাখা।
পুলিস সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই চার্টার্ড ফার্মের সূত্র ধরেই গোবিন্দের সঙ্গে যোগাযোগ হয় আয়কর শীর্ষ কর্তার। নীরজ যেখানে তল্লাশিতে যেতেন, সেখানে থাকতেন গোবিন্দ। অভিযোগ, তিনিই আয়কর হানায় ধরা পড়া ব্যক্তিদের সঙ্গে শীর্ষ কর্তার সমঝোতা করাতেন। শুধু ডেপুটি ডিরেক্টর নন, তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা, কয়লা মাফিয়া, গোরু পাচার, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বেআইনি আয়ও তাঁর হাত ঘুরেই হয়ে যেত বৈধ।
পুলিস সূত্রে খবর, হোটেল, রিয়াল এস্টেট, নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল সেক্টরে বেনামে লগ্নি করেছিলেন নীরজ এবং গোবিন্দ। দেশের বড় বড় শহরে তাঁদের বেনামি সম্পত্তি থাকার অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে, এই এফআইআরের ভিত্তিতে তদন্তে নামে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। চলতি বছরই মুম্বইতে নীরজের প্রায় চার কোটি টাকার বেনামি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ইডির জেরার মুখে পড়েন নীরজ। কিন্তু তিনি গোবিন্দের সঙ্গে যোগাযোগ অস্বীকার করেন। এদিনও গ্রেপ্তারি নিয়ে তাঁর কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। 
গোবিন্দের আইনজীবী বিপ্লব গোস্বামী অবশ্য জানিয়েছেন, যাবতীয় অভিযোগ ভিত্তিহীন। ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর পর্যন্ত ছ’বার তাঁর মক্কেলকে ডেকে পাঠিয়েছিল পুলিস। প্রতিবারই তিনি হাজিরা দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হল।