সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক, কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার বা ... বিশদ
পীত সুগন্ধী ঘৃতে অন্ন সিক্ত কৈল।/চারিদিকে পাতে ঘৃত বাহিয়া চলিল।।/কেয়াপত্র কলার খোলা ডোঙ্গা সারি সারি।/চারিদিকে ধরিয়াছে নানা ব্যঞ্জন ভরি।।/দশ প্রকার শাক নিম্ব সুকতার ঝোল।/মরিচের ঝাল ছানাবড়া, বড়ী, ঘোল।।/দুগ্ধতুম্বী, দুগ্ধকুষ্মাণ্ড, বেসারি লাফরা।/মোচা ঘণ্ট , মোচা ভাজা বিবিধ শাকরা।।
পঞ্চদশ শতকে ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ এই নিরামিষ রসনাতৃপ্তির এমন ছবিই পাওয়া যায়, তা সত্যিই বেশ লোভনীয়।
এর পাশপাশি তাঁর খাদ্যতালিকায় থাকতো, পটলভাজা, ফুলবড়ি ভাজা, মুগের ডাল প্রভৃতি। মধ্যযুগীয় নিরামিষাশী বৈষ্ণবদের শেষপাতের অম্বল ছিল বিশেষ পদ। ‘তেঁতুলের ঝোল’ বা জলপাইয়ের টক ছিল বেশ পছন্দের খাদ্য।
মাথায় রাখবেন তখনও বাঙালি ছানার স্বাদ পায়নি। তাই সন্দেশ বা রসগোল্লার চল সেসময় ছিল না। তবে মিষ্টির তালিকায় মুগের বড়া, মাষকলাইয়ের বড়া, পায়েস, ক্ষীরপুরী, নারকেলপুলির সদর্প উপস্থিতি। চৈতন্যদেবের সবথেকে পছন্দের পদটি হল দুধলাউ।
‘চৈতন্যভাগবত’- নিমাইয়ের রসনাতৃপ্তির প্রসঙ্গে বারবার এসেছে দুগ্ধ-লকলকির বিবরণ। শচীমায়ের হাতে তৈরি এই পদ নাকি তাঁর ভীষণ প্রিয় ছিল। চৈতন্যদেবকে অনুসরণ করেই যুগ যুগ ধরে বৈষ্ণবরা নিরামিষকেই তাদের খাদ্যধারা মেনে চলেছেন। এমনকী মুসুর ডাল ও পুঁই শাককে আমিষ বলেই মানতেন। এখনও কাটোয়ার শ্রীপাট গৌরাঙ্গবাড়ি ও মাধাইতলাতে কৃষ্ণের ভোগে পুঁই ও মুসুর ডালকে অশুচি মানা হয়।
মধ্যযুগে বাঙালির নিরামিষ খাদ্যধারার প্রাণপুরুষ চৈতন্যদেব। তিনি শুধু যে ভক্তিবাদী আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিলেন এমনটা নয়। তার প্রভাবে বদলে গেছিল বাঙালির খাদ্যাভাস।
সেই বাঙালি কি আমিষেই মজে গেল? আসলে এ বঙ্গদেশের আমআদমি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বদলেছে বারবার। এখন বাঙালির আট থেকে আশি নিরামিষে অরুচি। তবে কখনও বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীবার আর শনিবার বড়ঠাকুর তাই এই দুদিন কলাইয়ের ডাল, পোস্ত, সঙ্গে ভাজা এই দিয়ে পেটপুজো সারতে হয়। এবঙ্গের ঘটিবাড়ির নিরামিষভোজন পর্ব। ওপার বাংলার মানুষদের আবার নিরামিষে অরুচি। ক্ষমা ঘেন্না করে কখনও কখনও নিরামিষ মুখে তুলতে হলে — ধোঁকা, কুমড়োর ছক্কা, ছেঁচকি থেকে ছেঁচড়্যা ঘন্ট থেকে ঘ্যাট সবই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে থাকবে মেনুতে। পুববাংলা মানুষজন নিরামিষ বলতে বোঝে ভোগ। সে দুর্গাপুজো হোক, বা লক্ষ্মীপুজো সবেতেই জয়জয়কার খিচুড়ি, লাবড়া, আলুরদম থেকে পাঁচভাজা।
চারদিকে আমিষের এত জয়জয়কার হলেও মানুষ আমিষ খাওয়া শুরু করেছে অনেক পরে। আগে তো ফলমূলই ছিল ভরসা। এরপর শিখল আগুনের ব্যবহার। আলু থেকে বেগুন একটু সেঁকে মুখে তোলা। তারপর সটান পেটে চালান। কিন্তু মানুষ তো বুদ্ধিমান প্রাণী। তায় শুধু পোড়া সেঁকাতে আটকে থাকবে কেন। পাত্র আবিষ্কারের পরই শুরু হল সেদ্ধ করে খাওয়া পদ্ধতি। সেদ্ধতেই শেষ নয় রন্ধন ব্যাকরণ। এরপর এল ফ্রাই যাকে বলে ভাজাভুজি। লক্ষ্য করে দেখবেন বাঙালির নিরামিষ রান্নায় সেঁকা,সেদ্ধ থেকে ফ্রাই সবই আছে বহাল তবিয়তে।
এত গেল সেই আদ্দিকালের কথা। এবার আসা যাক মধ্যযুগের নিরামিষ ইতিহাসে। বাংলাদেশ বা পূর্ব-ভারতে ডালের চাষ শুরু হয় অনেক পরে। তবে ডালের সংস্পর্শে আসার পরেই বাঙালির হেঁশেলে পাকাপাকি জায়গা করে নেয় এই শস্য। মনে করা হয়, দক্ষিণের সেন রাজবংশ এবং উত্তর-পশ্চিম থেকে ইসলামের আগমনের সঙ্গেই ডাল রন্ধন চালু হয় এদেশে। সেখান থেকেই এ বাংলায় ডালের অনুপ্রবেশ ঘটে। ‘ব্যঞ্জন রত্নাকার’ বইয়ে মুগ, অড়হর, মসুর এবং কলাই ইত্যাদি ডালের বিভিন্ন পদের উল্লেখ রয়েছে।
কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে ভাতের সঙ্গে আহার্য কিছু পদের হদিস রয়েছে যেমন— ‘নটে রাঙা তোলে শাক পালঙ্গ নলিতা/তিক্ত ফল তাঁর শাক কলতা পলতা/সাঁজতা বনতা বন পুঁই ভদ্র পলা/নটুয়া বেথুয়া তোলে ফীরে ক্ষেতে ক্ষেতে/মহুরী শুলকা ধন্যা ক্ষীর পাই বেটে।’
দেশীয় শাকপাতাও ছিল ভাতের সঙ্গে সহকারী পদ। কখনও ভর্তা, কখনও বা ঝোল-তরকারি। এবার দেখা যাক সবজির সূচনা কীভাবে হল। পঞ্চদশ শতকের ‘মনসামঙ্গল’ এবং ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে কচু, বেগুন, লাউ, কুমড়ো, পটল, উচ্ছে, ঝিঙে, শিম, কাঠালবিচি, নিম, কাঁচকলা ইত্যাদি অজস্র নিরামিষ পদ দিয়ে বাঙালির নিত্যদিনের সঙ্গী। পর্তুগীজদের বাংলায় আগমনে বাঙালি হেঁশেলে প্রবেশ করল নতুন কিছু সব্জি। যেমন সপ্তদশ শতকে এল আলু। এরপর এসেছিল টমেটো এবং কাঁচালঙ্কা। ভাবুন যে আলু আর লঙ্কা বাঙালির রসুইঘর দখল করে রয়েছে তা খাঁটি বিদেশি। একেই বোধহয় বলে সাচ্চা অনুপ্রবেশ।
আসলে বঙ্গদেশের খাদ্যসংস্কৃতি স্রোতস্বিনী নদীর মতো। যার গতিধারায় মিশে রয়েছে চার সহস্র বছরের খাদ্যধারা। আজ বাঙালির শয়নে স্বপনে জাগরণে আমিষের পদচারণা হলেও চরিত্রে কিন্তু এ বাংলা ঘোরতর নিরামিষাশী।
তাপসী দত্ত দাস