পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
নাড়ু, মালপোয়া, রসবড়া, ছাবা এসব গরিব, মধ্যবিত্তের রসনায় তৃপ্তি দিলেও সন্দেশ বস্তুটি ছিল বরণ স্পেশাল। যা বনেদি বাড়ির পাকশালার স্পেশাল। সেকালে মা দুর্গাকে বরণ করা হতো ছানার সন্দেশ দিয়ে। মনে করা হতো মায়ের মুখে ছানার সন্দেশ দেখেই নাকি নীলকন্ঠ পাখি কৈলাসে উড়ে যেত উমার পতিগৃহে ফেরার সন্দেশ নিয়ে। অনেক পরে সাধারণের বিজয়াপর্বে যোগ হয় সন্দেশ।
দুর্গা কন্যারূপে ফি বছর পিত্রালয়ে আসেন তিন দিনের ছুটিতে। দশমীতে ঘরের মেয়ের কৈলাসে ফেরার পালা। চার দিনের আনন্দের শেষে দশমীর পর বিষাদের সুর বাঙালির মনে। তবে এই বিষাদের আবহেই সমানতালে চলে মিষ্টিমুখের আয়োজন। তাই দশমীর সকাল থেকেই উত্তর থেকে দক্ষিণ, পাহাড় থেকে সমতল বাড়ির কর্তাদের লাইন পড়ে পাড়ার মিষ্টির দোকানে। বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপোতভাবে জড়িত ঐতিহ্যের টান। কলকাতার ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যাবে বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজোর পর মিষ্টির ভিয়েনে বসিয়ে তৈরি হতো বিজয়ার মিষ্টি। ঢাকের বোলে বিদায়ের ছন্দ বাজলেই ময়রাদের কড়ায় পাক হতো সন্দেশ, জিবেগজা, রসবড়া, মনোহরা, মিহিদানা, সীতাভোগ।
শুধু বনেদি বাড়ি নয় বিজয়ার মিষ্টিমুখের রেওয়াজ ছিল গরিব গুর্বোদের ঘরেও। সেখানে এত আড়ম্বর না থাকলেও নারকেল নাড়ুর উপস্থিতি জানান দিত পুজো শেষ। কলকাতার বনেদি বাড়িগুলোতে কোথাও কোথাও এখনও তৈরি হয় বিজয়ার মিষ্টি। কিন্তু বেশিরভাগ বনেদি বাড়িতেই বাজার থেকে কেনা মিষ্টি দিয়েই সার হয় বিজয়াপর্ব।
এখনও বাঙালির বিজয়া দশমীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঘরোয়া সংস্কৃতি। যদিও কালের নিয়মে বদলে গেছে বহু রীতি। তবে অন্তরের টান এখনও টিকে আছে। এককালে ঠাকুমা কিংবা দিদিমার হাতের তৈরি মালপোয়া বা নাড়ুর স্বাদ ছিল বিজয়ার পরম প্রাপ্তি।
বাঙালি অবশ্য মিষ্টির ক্ষেত্রে নতুন পুরনো সব স্বাদেই ভরসা রাখে। তাই বিজয়ায় যেমন পুরনো জমানার মিষ্টি জলভরা তালশাঁস সন্দেশ, শাঁখ সন্দেশ বা কালাকাঁদ থাকে তেমনই গোলাপ সন্দেশ, কাজু বরফি, আইসক্রিম সন্দেশ বা স্যান্ডউইচ সন্দেশ পছন্দও বঙ্গবাসীর। আবার নতুন প্রজন্ম ফিউশনে বিশ্বাসী। তাই তারা অনেকেই খোঁজেন চকোলেট মিষ্টি। চকোলেট সন্দেশ, চকোলেট ক্ষীরকদম, চকো রোল, চকোলেট রসগোল্লার মতো মিষ্টিও এখন রাখতে হয় ক্রেতা টানার জন্য।
তবে সেকালে কলকাতায় বিজয়ার অ্যাপায়ন ছানার ‘সন্দেশ’ দিয়ে হত না— ‘নারকেল ছাপ’ দিয়ে হত। মহেন্দ্রনাথ দত্ত জানিয়েছেন, ‘বিজয়ার দিন নারিকেল ছাবা দেওয়া হইত। বিজয়ার কোলাকুলিতে সন্দেশ বা অন্য কোন খাবার চলিত না।’
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টায় রীতি। নারকেল ছাবা দিয়ে এখন বিজয়া কথা ভাবতেও পারেন না আমবাঙালি। তিথি মতে দেবী দুর্গার বিসর্জন হলেই শুরু হয় বিজয়া দশমীর পালা। কিন্তু একটা সময়ে মহালয়ার পর থেকেই বাড়ির মহিলা মহলে শুরু হয়ে যেত বিজয়া দশমীর প্রস্তুতি। গাছ থেকে নারকেল পাড়িয়ে ঘরে জমা করা, ঘষেমেজে সন্দেশের ছাঁচগুলিকে প্রস্তুত করে রাখা, মিষ্টির জন্য গুড়-চিনি এবং নিমকির জন্য ডালডার টিন মজুত রাখা আরও কত কি?
সন্দেশ নিয়ে যখন এত আলোচনা হল তখন সেকালে সন্দেশের বাজার দর উল্লেখ না করলেই নয়। কাটোয়াতে হাতে লেখা মহাভারতের তালপাতার পুঁথিতে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের দু্র্গাপুজোর খরচের একটি ফর্দ পাওয়া যায়। সেই দুর্গাপুজোয় মোট খরচ হয়েছিল ৮০ টাকা ১৪ আনা ২ পাই পয়সা। এর মধ্যে প্রতিমার দাম ৫ টাকা, এক মন ঘি কেনা হয়েছিল ৫ টাকা, ৪ মন ময়দা ২ টাকা ৬ আনা। ক্ষীর কেনা হয় ৫ টাকার, সন্দেশ ৭ টাকার— তবে মিষ্টির ওজনটা লেখা ছিল না।
মিষ্টির এত বাহার থাকা সত্ত্বেও আজও বাঙালির কাছে বিজয়া মানে মন খারাপ। তাই দশমী মিষ্টির একাল–সেকাল থাকলেও মায়ের বিদায় ব্যথা যেন চিরকালের। আবার একটি বছরের অপেক্ষা।
তাপসী দত্ত দাস