সায়ন্ত ভট্টাচার্য, কলকাতা: বরফ দেওয়া থার্মোকলের বাক্সের ভিতরে বোঝাই করে চলে আসছে ‘রুপোলি শস্য’। কোথাও নদীপথ, কোথাও কাঁটাতারের ফাঁক গলে এপারে তারা। চকচক করতে থাকা আটশো থেকে এক কেজি ওজনের সেই ইলিশ দেখলেই যেন মনে ভরে যায়। দামে একটু বেশি হলেও বাক্সের বাইরে বেরিয়ে আসতেই নিমেষেই হাওয়া যায়। আশেপাশের জেলাতেও যে কিছু যাচ্ছে না তা নয়, আসলে ওই ইলিশের এমন চাহিদা যে আগাম বরাত দিয়েও রেখে দেন অনেকে। আর এই চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে চলতি বছরে ইলিশ পাচারের সংখ্যা বিগত সব মরশুমের পরিসংখ্যানকে ছাপিয়ে গিয়েছে। বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ার চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যে রিপোর্ট তৈরি করেছে, তাতে দেখা গিয়েছে, পড়শি দেশ থেকে এখনও অবধি এরাজ্যে ইলিশ পাচারের পথে ধরা পড়েছে মোট ৩ হাজার ৮৮৮ কেজি। এসব ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ধরা পড়েছে ১৬ জন ভারতীয়। অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের অধীন এলাকায় ধরা পড়েছে প্রায় ৫০০ কেজির কাছাকাছি। সব মিলিয়ে চার হাজার কেজির বেশি ইলিশ এখনও পর্যন্ত এরাজ্যে পাচার হতে গিয়ে ধরা পড়েছে। বিএসএফ কর্তাদের কথায়, বাংলাদেশে সুস্বাদু ইলিশের দাম তুলনায় অনেক কম। সেসব এদেশে সস্তায় কিনে এনে মোটা দামে বিক্রি করার উপরই জোর দিচ্ছে অসাধু কারিবারিরা। ক্রেতারা বাংলাদেশি ইলিশ পেয়ে যত দামই হোক, তা কিনতে ইতস্তত করছেন না। ফলে কেজি প্রতি ব্যাপক দাম পেয়ে লাভবান হচ্ছে ওই কারবারিরা। পেট্রাপোলে কর্মরত কাস্টমসের এক কর্তা ফোনে বললেন, এই বিপুল পরিমাণ ইলিশ পাচার রুখে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইলিশ একেবারেই যে পাচার হয়নি, এমন নয়। বাংলাদেশ থেকে এপারে ইলিশ এসেছে। কিন্তু ওপারের নজরদারি অভাবে পাচার যেভাবে বেড়েছে, তাতে আমরা রাজস্ব ক্ষতির মুখে পড়েছি। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সৎ ব্যবসায়ীরাও।
দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের ডিআইজি এস এস গুলারিয়া বলেন, চলতি মরশুমে যে পরিমাণ ইলিশ ওপার থেকে চোরাই পথে এপারে এসেছে, তা আগে কখনও হয়নি। উত্তরবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারে ইলিশ পাচারের পরিমাণ অনেকটাই কম। মালদহ-মুর্শিদাবাদ থেকে পাচার হয়েই তা সহজে উত্তরবঙ্গে পৌঁছে যেত। তাই দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের সীমান্তকে ইলিশ পাচারের প্রধান করিডর হিসেবে বেছে নিয়েছে পাচারকারীরা।
দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের রিপোর্ট বলছে, ২০২০ সালে ১০০ কেজি বা তার বেশি ইলিশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে ন’বার। বর্ডার আউটপোস্ট অনুযায়ী সেগুলি হল, গত ২৩ জানুয়ারি তারালিতে ১০০ কেজি, ২৯ জানুয়ারি গরজোলায় ৩০০ কেজি, ২ ফেব্রুয়ারি ১৪০ কেজি, ২২ আগস্ট ফর্জিপাড়ায় ৬০০ কেজি, ৩০ আগস্ট বামনাবাদে ১৪০ কেজি, ২ সেপ্টেম্বর কল্যাণীতে ১০০ কেজি ও ফর্জিপাড়ায় ১৯০ কেজি, ৪ সেপ্টেম্বর কল্যাণীতে ২০০ কেজি এবং ২৩ সেপ্টেম্বর পেট্রাপোল চেকপোস্টে ১০০ কেজি ইলিশ মাছ উদ্ধার হয়েছে। এছাড়াও চলতি বছরে আরও ৫৪ বার বসিরহাট থেকে মালদহ সীমান্তের মধ্যে ওপার থেকে ইলিশ পাচার হয়েছে।
বিএসএফের এক কমান্ডান্ট বলেন, বসিরহাট এবং বনগাঁ—এই দু’টি মহকুমার সীমান্ত দিয়ে ইলিশ ঢোকার ঘটনা সর্বাধিক। ইছামতীকে মাধ্যম করে রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন উপায়ে ইলিশ ঢোকানোর চেষ্টা হয়েছে। কিছুক্ষেত্রে পাচারকারীরা সফল হওয়ায় এপারে ক্রেতাদের কাছে সেই ইলিশই দ্বিগুণ দামে পৌঁছচ্ছে।