পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
বিশ্বভারতীর প্রধান লক্ষ্য যদি একটা নীড়ে বহু বৈচিত্র্যকে আশ্রয় দেওয়া হয়, তবে এই বিশ্বনীড়ে চীনভবন হল একটি বিশেষ উপাদান। অভারতীয় প্রাচ্য ঐতিহ্যের এটি আমাদের সবচেয়ে বড় অবলম্বন। ৮৩ বছর আগে ‘বিশ্বভারতীর মধ্যমণি’ চীনভবনের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। রবীন্দ্র-জীবনকালে শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠিত চীনভবনই বিশ্বভারতীর ‘একটি বিরাট হিয়ায়’ সর্বশ্রেষ্ঠ স্বতন্ত্র প্রাচ্য বিদ্যাকেন্দ্র।
শান্তিনিকেতনে চীনভবন প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা পল্লবিত হয়ে রূপ নেওয়ার পিছনে কবির বিশিষ্ট সহযোগী হিসেবে প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ তান-য়ুন-শানের নাম অবশ্যই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। চীন-ভারত শিক্ষা সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম রূপকার ‘ভারতবন্ধু’ অধ্যাপক তান চীনভবনে বহু লুপ্তপ্রায় মূল্যবান দুষ্প্রাপ্য বৌদ্ধগ্রন্থ উদ্ধার, সম্পাদনা এবং অনুবাদের কাজ করেছেন। তিনি উদ্ধার করেছেন বহু মূল্যবান নথিপত্রের। ভারত ও চীন এই দু’টি দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ও সম্পর্ককে অধ্যাপক তান সারাজীবন ধরে বহন করে চলেছিলেন। তান ছিলেন সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধী ভারতের অকৃত্রিম বন্ধু।
সম্প্রতি চীনের ভারত আক্রমণ ও আগ্রাসী মনোভাবের আবহে শান্তিনিকেতনে এক ঐতিহাসিক ঘটনার কথা মনে পড়ে। দেখতে দেখতে তাও প্রায় ৫৮বছর হয়ে গেল। ১৯৬২ সালে আম্রকুঞ্জে বিশ্বভারতীর বার্ষিক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিশিষ্ট মানুষজন ও আশ্রমিকদের সঙ্গে অনুষ্ঠানবেদির সামনে প্রথম সারিতে বসেছিলেন তান য়ুন শান। বিশ্বভারতীর তদানীন্তন আচার্য ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সমাবর্তনের মনোজ্ঞ ভাষণে নানা বিষয়ের মধ্যে বলেছিলেন যে, চীন ভারতকে আক্রমণ করেছে। এই কথা শোনামাত্র সামনে প্রায় ধ্যানস্থ বুদ্ধমূর্তির মতো বসে থাকা অধ্যাপক তানের দুই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। এইরকম আবেগঘন মুহূর্তটিকে নেহরুজি বিশেষভাবে লক্ষ্য করেন। বক্তৃতা শেষে পণ্ডিত নেহরু অনুষ্ঠানবেদি থেকে সরাসরি নেমে এসে তান য়ুন শানকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেন। নেহরুজি তাঁর ভাষণে চীন-ভারত সম্পর্ক স্থাপনে রবীন্দ্রনাথ ও তান-য়ুন-শানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। অধ্যাপক তানের এককালের সহকারী ও পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের উপগ্রন্থাগারিক বীরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং ৭০ দশকের মাঝামাঝি চীন ভবনে স্বয়ং তান সাহেবের মুখেও এই ঘটনার শোনার বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
১৯২৭ সালে কবির দ্বিতীয়বারের চীনযাত্রার সময়, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তান-য়ুন শানের সাক্ষাৎ হয়। গুরুদেবের আমন্ত্রণে ১৯২৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে শান্তিনিকেতনে আসেন তিনি। যোগ দেন চীনাভাষার অধ্যাপক হিসেবে। সেই বছর থেকেই মাত্র পাঁচজন ছাত্র নিয়ে তিনি শান্তিনিকেতনে চীনাভাষার ক্লাস শুরু করেন। বিশ্বভারতীতে তিন বছর অধ্যাপনার পর, কবির আশীর্বাদ ও শুভকামনা নিয়ে অধ্যাপক তান ১৯৩১ সালে আবার চীনে ফিরে যান। ১৯৩৩ সালে চীনের নানকিনে ‘তান সাহেব’ প্রতিষ্ঠা করলেন ‘সিনো-ইন্ডিয়ান কালচারাল সোসাইটি’ বা ‘চীন-ভারত সংস্কৃতি সমিতি’। ভারতবর্ষে এই সমিতির সভাপতি হলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এই সমিতির কর্মসূচি অনুযায়ী প্রধান ও প্রথম কাজ ছিল চীনভবন প্রতিষ্ঠার কর্মকাণ্ডকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে ত্বরান্বিত করা।
শান্তিনিকেতনে চীনভবন প্রতিষ্ঠার জন্য চীন দেশ থেকে প্রায় যাবতীয় কাজ শেষ করে, সংগৃহীত সব অর্থ, লক্ষাধিক বহু দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ নিয়ে ১৯৩৬ সালে তান-য়ুন-শান যখন শান্তিনিকেতনে ফিরলেন, তখন আশ্রমে ভরা বসন্তকাল। এরপর চীনভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়। ১৯৩৭ সালে ১৪ এপ্রিল নববর্ষের দিনে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ আনুষ্ঠানিকভাবে চীনভবনের উদ্বোধন করেন। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন। সুদীর্ঘ ৫৫ বছর ভারতীয় আচার্যদের মতো অধ্যাপক তান শান্তিনিকেতনে বসবাস করে গিয়েছেন।
আশ্রমগুরু রবীন্দ্রনাথ চীন-ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিক্ষার সেতু বেঁধেছিলেন। গত বিশ-বাইশবছরে চীনের আবহাওয়া বদলেছে। হাওয়া লেগেছে মুক্ত উদারনীতির পালে। চীনের সঙ্গে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, পঠন-পাঠন, গবেষণার আদান-প্রদান বেড়েছে। আবার উল্টো দিক থেকে অরুণাচল প্রদেশ, ডোকলাম নিয়ে রণং দেহি মূর্তি। আবার অতি সম্প্রতি লাদাখের গলওয়ানে অপ্রত্যাশিতভাবে চীনের আক্রমণ ভারতীয়দের মনে গভীর আঘাত হেনেছে। এই দুই দেশের রাজনীতি ও কূটনীতির পরিসরেও ঘনিয়েছে অবিশ্বাসের বিশাল কালো মেঘ।
আজকের চীন-ভারত অশান্তির আবহে ভারততীর্থের শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর বিশিষ্ট সহযোগী তান-য়ুন-শানের সশ্রদ্ধ ভূমিকার কথা বার বার মনে হচ্ছে। ৮৩ বছর আগেই সেই চীনের উদ্দেশে উৎসর্গকৃত এক স্বতন্ত্র প্রাচ্যবিদ্যার শিক্ষাকেন্দ্র চীনভবন হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজনীন স্বপ্নের শরিক। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ও তান-য়ুন-শান