বাপ্পাদিত্য রায়চৌধুরী, কলকাতা: এতক্ষণ তো ঠাকুরের ছবি তুললে। আবার এত রাস্তার ছবি তোলার কী আছে? ঠিক করে হাঁটো। এক্ষুনি তো ধাক্কা খাচ্ছিলে! চেতলা অগ্রণীর সামনের রাস্তায় হঠাৎ বাঁক নেওয়া মারুতির সামনে পড়েও কোনওরকমে রক্ষা পেলেন তরুণী। তাতেই চটে গিয়ে মেয়েকে বকুনি দিলেন প্রৌঢ়া। তাতে কর্ণপাত করলেন না তরুণী। বরং পাল্টা জবাব, ফটোগ্রাফির তুমি কিস্যু বোঝো না। মা থমথমে মুখে চুপ থাকলেন। কিন্তু তাঁর নীরবতা আর টিকল কই? বিকেল হতে তখনও দেরি। চড়া রোদ। তবু রাস্তায় লক্ষ লোক। তাদের কোলাহলে গমগম করছিল রাজপথ। চতুর্থী থেকে যে উন্মাদনা শুরু হয়েছিল, মহাপঞ্চমীতে তাতে যেন জোয়ার লাগল। চুরমার হয়ে গেল শহুরে গাম্ভীর্য। মাইকে বাজতে থাকা আশা ভোঁসলের গানে, চাউমিনের মস্ত তাওয়ায় ডিমভাজার সুবাসে, আলোয়, সেলফির উল্লাস আর ট্রাফিক পুলিসের চোখ রাঙানিতে পুরোদস্তুর উৎসবে মাতল কলকাতা। সন্ধ্যায় যখন দেবীর বোধন হল, তখন শহরের কোণে কোণে ঝলসে উঠছিল শারদ উৎসবের জৌলুস। চতুর্থীতে যদিও বা একটু ঢিলেমি ছিল ট্রাফিকে, বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই তা একেবারে কঠোর শৃঙ্খলায় বাঁধল পুলিস। ধরা যাক মধ্য কলকাতার কথাই। বিকেলের মুখে সোনায় মোড়া দুর্গা দেখতে লেবুতলা পার্কের দিকে এগচ্ছিল ভিড়। কিন্তু আমহার্স্ট্র স্ট্রিটের মুখেই পুলিস যানবাহনের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াল। ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার মোড় আসার আগেই পার্কিং আটকালো পুলিস। লেবুতলা পার্কের সামনেই পুলিসের সঙ্গে বচসা বাধিয়ে দিলেন এক কর্মকর্তা। বাঁশ বোঝাই ম্যাটাডোর কী এমন অপরাধ করল ওই চত্বরে ঢুকে, তা নিয়ে তীব্র বাদানুবাদ শুরু হল। ঠাকুর দেখার সঙ্গেই ওই বাগবিতণ্ডা ছিল ফাউ। যাঁরা শখ করেছিলেন ফুরফুরে মেজাজে গাড়িতে চেপে কলেজ স্কোয়ার বা মহম্মদ আলি পার্কের ঠাকুর দেখবেন, তাঁদের আশায় জল ঢালল পুলিস। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে ডাইনে-বাঁয়ে একের পর এক রাস্তা নো এন্ট্রি করা হল। কিন্তু তাতে মানুষ হার মানবেন কেন? হেঁটেই রওনা দিলেন তাঁরা। কে বলবে, এখনও নির্ঘণ্ট মেনে শুরুই হয়নি পুজো। তার আগেই উত্তরে কুমোরটুলি পার্ক, আহিরীটোলা, কাশী বোস লেন, জগৎ মুখার্জি পার্কের মতো পুজোগুলোয় হাজির হতে রাজপথে হাজার হাজার মানুষ। গলি খুঁজে খুঁজে যাঁরা বিকল্প পথ বার করছিলেন, তাঁদেরও প্রণাম পেলেন বহু অনামী ছোট মণ্ডপের দুর্গা।
বাগবাজার সর্বজনীনে না এলে যাঁদের পুজো পরিক্রমা অপূর্ণ থাকে, তাঁদের অনেকেই এখানে পৌঁছে বিভোর হয়ে দেখছিলেন মায়ের চিরন্তনী রূপ। ফি বছরের মতো এখানে মেলা বসেছে এবারও। ফিশ ফ্রাই, টিভি চ্যানেলের স্টলের ক্যুইজ আর বেলুনের দুলুনিতে মজেছে চারদিক। চত্বরের বাইরের রাস্তায় তখন থিকথিকে ভিড়। তারই মাঝে বাঁশের উপর খাটানো দড়িতে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল এক মলিন বালিকা। হিন্দি গানের সঙ্গে দুলে দুলে ভারসাম্যের খেলা দেখতে লাগল সে। হাততালি পেল না। তবে টাকা ছুঁড়ে দিল অনেকে। মাইকে গান বাজছিল, বাজল তোমার আলোর বেণু। সেই আলোটুকু পৌঁছল না বালিকার আঙিনায়।