বিশ্বজিৎ মাইতি, বসিরহাট: কয়েক মাস আগে বসিরহাট উত্তরের বাম বিধায়ককে দলে টেনে বিরোধীদের কোমর ভেঙে দিয়েছিল শাসক শিবির। এবার সেই প্রাক্তন বাম বিধায়ক রফিকুল ইসলাম মণ্ডলকে প্রার্থী করে বিরোধীদের  মনোবল ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৃণমূল নেতৃত্ব। এই কেন্দ্রে লোকসভায় বিপুল ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে ছিল শাসকদল। সেই ব্যবধানকে এবার টপকে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগচ্ছে তারা। অন্যদিকে, মীরজাফর, গদ্দারের মতো চোখা চোখা বিশ্লেষণ ব্যবহার করে তৃণমূলকে টেক্কা দিতে ময়দানে নেমেছে সংযুক্ত মোর্চা সমর্থিত আইএসএফ প্রার্থী। মেরুকরণ ও সোনার বাংলার গড়ার স্বপ্নে বাজিমাত করতে চাইছে গেরুয়া শিবিরও। তবে এলাকাবাসীর দাবি, বিরোধী ভোটের বিভাজন এই কেন্দ্রে শাসকদলের প্রার্থীকে অনেকটাই সুবিধাজনক জায়গায় রেখেছে। 
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১১ সালে বসিরহাট বিধানসভা এলাকা ভেঙে বসিরহাট উত্তর এবং দক্ষিণ— এই দু’টি বিধানসভা কেন্দ্র তৈরি হয়। বসিরহাট উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে হাসনাবাদ ব্লকের ৪টি ও বসিরহাট‑২ ব্লকের ৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে। মোট ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় সংখ্যালঘু ভোট প্রায় ৬২ শতাংশ। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই এলাকায় একরের পর একর মাছের ভেড়ি ও ইটভাটা রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সংখ্যালঘু এলাকায় জামা‑কাপড় তৈরির কাজে যুক্ত প্রচুর মানুষ।  মুরারিশা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় মাছের ভেড়ি ও ইটভাটার ভিতর দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে ছবির মতো আঁকাবাঁকা পিচ রাস্তা। মাছ ধরার ব্যস্ততা কাটিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুর গাজি, মফিজুল ইসলাম বলেন, আমরা কি দেশের নাগরিক নই? আমরা কি দেশের শত্রু? আমরা এত বছর ধরে হিন্দু‑মুসলিম পাশাপাশি রয়েছি। আমরা দুর্গাপুজোর মেলায় যাই। ওরা ইদের সিমাই খেতে আসে। মাছের ভেড়ি ও ভাটায় অমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি। তাহলে কেন এই অবিশ্বাসের ছবি ভোটের আগে তৈরি করা হচ্ছে? আগে তো এমন ছিল না। এখন তো সারা দেশেই আমাদের গণশত্রু বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সম্প্রীতি রক্ষায় তাই এবারও আমরা দিদিকে চাই।
মুরারিশা বাজারের চায়ের দোকানে খবরের কাগজ হাতে রাজনীতির আড্ডায় মশগুল রহমৎ আলি, বাদশা আলম, সুবল মিস্ত্রিরা। ভোটের হাওয়া প্রসঙ্গে সুবলবাবু বলেন, এই এলাকায় সম্প্রীতি বড় বিষয়। এত বছর ধরে হিন্দু‑মুসলিম ভাই ভাই হয়ে রয়েছি। কখনও কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে আমাদের মধ্যে ভাগাভাগির চেষ্টা করা হচ্ছে। এই ভাগাভাগি হলে নেতাদের লাভ হতে পারে, আমাদের কী হবে বলুন তো। এলাকায় শান্তি না থাকলে ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাঁচব কী করে। তাই এবার মানুষ সম্প্রীতি রক্ষায় ভোট দেবে। হাওয়া কার দিকে প্রশ্ন করায় সকলেই বলেন, প্রচার, মিটিং সবেতেই এগিয়ে তৃণমূল। সারা বছর তারাই মানুষের পাশে থাকে। তাই তাদের সম্ভাবনাই জোরদার।
এই কেন্দ্রে ২০১১ সালে তৃণমূল প্রার্থী এটিএম আবদুল্লা সিপিএম প্রার্থী সুবিদ আলি গাজিকে প্রায় ৩১ হাজার ভোটে পরাজিত করেন। ২০১৬ সালে সিপিএম প্রার্থী রফিকুল ইসলাম মণ্ডল তৃণমূল প্রার্থী এটিএম আবদুল্লাকে প্রায় ৫০০ ভোটে পরাজিত করেন। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে এই কেন্দ্রে আশি হাজারের বেশি ভোটে এগিয়ে ছিল শাসকদল। এবার এই কেন্দ্রের বাম বিধায়ক রফিকুল সাহেব তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় শাসকদলের ভিত আরও মজবুত হয়েছে। এবারে এই কেন্দ্রে তৃণমূলের হয়ে টিকিট পাওয়ার অন্যতম দাবিদার ছিলেন প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক এটিএম আবদুল্লা। তাঁর সমর্থকরা প্রার্থী ঘোষণার পর ক্ষোভও দেখিয়েছিলেন। কিন্তু এলাকায় গিয়ে দলের প্রার্থীর হয়ে প্রচারে দেখা গেল খোদ আবদুল্লা সাহেবকে। তিনি বলেন, এই কেন্দ্রে তৃণমূলের ঘর কংক্রিট দিয়ে তৈরি। এখানে দলের প্রার্থী বিপুল ভোটে জিতবেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী করা আমাদের মূল লক্ষ্য।
তৃণমূল প্রার্থী রফিকুল সাহেব বলেন, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের জন্য বাড়ি বাড়ি যাচ্ছি। মানুষের সাড়া দেখে অভিভূত। এবার আমরা বিপুল ব্যবধানে জিতব। এই কেন্দ্রে প্রচারে সাড়া জাগানো আইএসএফ প্রার্থী বাইজিদ আমিন বলেন, যিনি বামে জিতে তৃণমূলে যেতে পারেন, তিনি তৃণমূলে জিতে ফের বিজেপিতেও যেতে পারেন। মানুষ এই সত্য বুঝেছেন। মীরজাফরকে হারানোর জন্য মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বিজেপি প্রার্থী নারায়ণ মণ্ডল বলেন, সোনার বাংলা তৈরির জন্য এই কেন্দ্রের মানুষ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছেন। মানুষ ধর্ম চায় না। পেটে ভাত চায়, হাতে কাজ চায়। একমাত্র বিজেপি এই রাজ্যের উন্নয়ন করতে পারে, সেটা মানুষ বুঝেছে।