নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: গত ২ সেপ্টেম্বর বউবাজারের ২/১বি, স্যাকরাপাড়া লেনের বাড়ি থেকে ধর্মতলা অঞ্চলের হোটেলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ৮৭ বছরের বৃদ্ধা অঞ্জলি মল্লিককে। তাঁর বাড়িতে সেরকম বড় ফাটল না দেখা গেলেও প্রাণহানি ঠেকাতে এবং সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো নির্মাণকারী সংস্থা কেএমআরসিএল কর্তৃপক্ষ তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যায়। সেই অঞ্জলিদেবীর আর বাড়ি ফেরা হল না! মঙ্গলবার রাত ১০টা ৪০ মিনিট নাগাদ তালতলা অঞ্চলের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি মারা যান। মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিকিৎসকরা সেপটিসিমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে অঞ্জলিদেবীর পরিবারের তরফে বলা হয়েছে, এমনিতে তিনি বয়সজনিত অসুস্থতা এবং পায়ের চোটে ভুগছিলেন। কিন্তু বউবাজারে সুড়ঙ্গ বিপর্যয়ের পর যে হোটেলে তাঁদের ওঠানো হয়, সেখানে হোটেলের ছোট্ট ঘর, খাওয়াদাওয়ার অব্যবস্থা ইত্যাদি কারণে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন অঞ্জলিদেবী। যা শেষপর্যন্ত তাঁর মৃত্যু ডেকে আনল। অঞ্জলিদেবীর দেহ বুধবার দুপুরে আনা হয় স্যাকরাপাড়া লেনে তাঁর বাড়ির সামনে। সেখান থেকে নিমতলা মহাশ্মশানে নিয়ে গিয়ে শেষকৃত্য করা হয়। তাঁর নাতি অন্বয় বসু বলেন, মেট্রো নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষই চিকিৎসক ডেকে প্রথমে আমার দিদাকে দেখায়। তাঁরাই হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। ৮ তারিখ তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল তালতলার ওই হাসপাতালে। এদিন সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিট নাগাদ তালতলার এই হাসপাতালে স্যাকরাপাড়া লেনের বাসিন্দা আরেক বৃদ্ধেরও মৃত্যু হয়। নাম গণেশপ্রসাদ গুপ্তা (৮৬)। তাঁর ছেলে কিশোরকুমার গুপ্তা বলেন, মেট্রো কর্তৃপক্ষের চিকিৎসকের পরামর্শেই আমার বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সুগার, ব্লাড প্রেসারের সমস্যা আগে থেকেই ছিল। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মারা যান তিনি। আমাদের বাড়িটি পুরো ভেঙে না পড়লেও হেলে পড়েছে। তার আগেই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। এই মৃত্যুর বিষয়ে পরিবারের তেমন কোনও অভিযোগ না থাকলেও অঞ্জলিদেবীর মৃত্যুর ক্ষেত্রে তাঁর পরিজনরা হোটেলের অব্যবস্থাকেই দুষেছেন। তাঁর নাতির মতে, এই অব্যবস্থার কথা বারবার জানিয়েও কোনও সুরাহা হয়নি। তবে এদিন কেএমআরসিএল এক সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করে, হোটেলের অব্যবস্থার কোনও অভিযোগ তারা পায়নি। কোনও অভিযোগ থাকলে তার সমাধানের জন্য আলাদা টিম রয়েছে বলে দাবি করেছে তারা।
এদিকে, বুধবার আরও ৩১টি পরিবারের অ্যাকাউন্টে ক্ষতিপূরণের টাকা পাঠিয়েছে কেএমআরসিএল কর্তৃপক্ষ। এই নিয়ে মোট ৮৩ জনকে ইতিমধ্যেই পাঁচ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিল তারা। যে পাঁচটি বাড়ি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা শেষ হলে তবেই আবার অন্য বিপজ্জনক বাড়ির মালিকের অনুমতি নিয়ে তা ভাঙায় হাত দেওয়া হবে। স্থানীয় কাউন্সিলার সত্যেন্দ্রনাথ দে এই কথা জানিয়ে বলেন, আমরা এখনও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা তৈরি করছি। মোট ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১৫০-র আশপাশে চলে যাবে বলে মনে করছেন তিনি।
কেএমআরসিএল-এর তরফে এদিন আরও জানানো হয়েছে, টানেলের নির্দিষ্ট অংশের মধ্যে জল ভরে সুড়ঙ্গে মাটির ধস আটকানোর যে প্রক্রিয়া, তা বুধবার রাতেই শেষ হবে। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভূমিক্ষয় পুরোপুরি বন্ধ হবে বলে আশা করছেন কর্তারা। পাশাপাশি বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট এবং ক্ষতিগ্রস্ত তিনটি লেন মিলিয়ে প্রায় ১৮টি দোকান এদিন চালু করার অনুমতি দিয়েছে কেএমআরসিএল কর্তৃপক্ষ। এই দোকানগুলিতে বিপর্যয় ধরা পড়ার দিন থেকেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। এদিন সেই সংযোগ ফের স্থাপন করা হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সব মিলিয়ে ১৯টি বাড়ি ভেঙে ফেলা হতে পারে। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে কেএমআরসিএল-এর বিল্ডিং মনিটরিং কমিটি। তারা এদিন বউবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে না এলেও আজ, বৃহস্পতিবার আসবে বলে জানা গিয়েছে। মঙ্গলবার এই কমিটির সদস্যরা মোট ১১টি বাড়ির অবস্থা খতিয়ে দেখেন। তাঁরা এই তিনটি লেনের ৭৪টি বাড়ির অবস্থা খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দেবেন। সেখানেই স্পষ্ট হবে, কোন বাড়ি কতটা মেরামত করা দরকার বা পুরোটা ভেঙে ফেলতে হবে কি না। তবে এদিন গ্রাউটিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।