শৌণক সুর, কলকাতা: ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির। ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা’—মহালয়ার সকালে রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের এই স্তোত্রই জানান দেয় মর্ত্যে দেবীর আগমন বার্তা। এক বছরের অপেক্ষা শেষে ফের ঘরে ফিরবেন উমা। প্রতিবারের মতো এবারেও ঘোটক, গজ, দোলা বা নৌকার মধ্যে একটিতে চেপে আসবেন তিনি। গমনও হবে এগুলিরই মধ্যে একটিতে। কিন্তু অন্যান্য সব দেবদেবীর মতো মা দুগ্গারও বাহন রয়েছে। যেমন তেমন নয়, এক্কেবারে পশুরাজ সিংহ। কিন্তু এহেন বাহন থাকা সত্ত্বেও কেন ঘোটক-গজ-দোলা-নৌকার প্রয়োজনীয়তা? বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছিল মিন্টো পার্কের রামকৃষ্ণ সারদা মণ্ডপের প্রধান পূজারি রবিশঙ্কর ঘোষালের সঙ্গে। তিনি জানান, সত্যযুগে মর্ত্যে যান হিসেবে ব্যবহার করা হতো ঘোড়া, গজ, নৌকা, পালকি। ফলে ওই সময় ধরায় দেবীর আগমন এবং প্রত্যাগমনের জন্য মূলত এই চারটি যানকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এইসব যানে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে শুভ-অশুভ প্রভাব। যেমন ‘নৌকা’, যার ফল আনন্দ-সর্বসুখ-শস্য এবং জলবৃদ্ধি। ‘ঘোটক’, যার ফল ছত্রভঙ্গ-রোগজ্বালা-ব্যাধি-অরাজকতা। ‘গজ’, যার ফল শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা। দোলা, যার ফল মড়ক-মহামারি-ব্যাধি। প্রতিবারই দেবীর আগমন-প্রত্যাগমনের এই যানগুলি তিথি, নক্ষত্র এবং দিনের বিচারে নির্বাচিত হয়। পুরাণ ও শাস্ত্র মতে, রবি এবং সোমবার দেবীর আগমন বা প্রত্যাগমনের যান হিসেবে ব্যবহৃত হয় গজ। বুধে ব্যবহৃত হয় নৌকা। বৃহস্পতি এবং শুক্রবার যান হিসেবে থাকে দোলা। শনি এবং মঙ্গলবার ব্যবহৃত হয় ঘোড়া। আগমনের এই দিনটি ধরা হয় মহাষষ্ঠীর দিন থেকেই। তবে ভৌমদোষ থাকলে যানের পরিবর্তন হতে পারে। এবার ঘোটকেই দেবীর আগমন এবং প্রত্যাগমন। কিন্তু সিংহের পিঠে চেপে আসতে বাধাটা কোথায়? রবিবাবু জানান, দুষ্ট অসুরকে দমন করতে মা দুর্গাকে সাহায্য করেছিলেন বিষ্ণুরূপী সিংহ। তাই বাহন হলেও তাঁর পিঠে চেপে মর্ত্যে আসেন না দেবী। আর বিষ্ণুরূপ হওয়ার জন্যই মণ্ডপে দেবী প্রতিমার প্রাণ প্রতিষ্ঠার আগে মহাষষ্ঠীর রাতে, অধিবাসের সময় দুর্গার বাহনরূপী সিংহকে পৈতে পরানোর রীতি রয়েছে। প্রথমে ধ্যানমন্ত্রের মাধ্যমে ফল-মিষ্টি দিয়ে নৈবেদ্য দেওয়া হয়। এরপর আরতি শেষে সিংহকে পরানো হয় পৈতে। এই উপাচারের পরই সপ্তমীতে সোনা, রুপো বা মাটির তৈরি মোট আটটি ঘটে দুর্গারূপী নবপত্রিকাকে স্নান করানো হয়। রীতি অনুযায়ী, স্নানের সময় এক একটি ঘটের জন্য বাজানো হয় ঢাকের পৃথক পৃথক বোল। এই রীতি সম্পন্ন হওয়ার পর দেবী দুর্গার চক্ষুদান এবং প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাশাপাশি একাধিক উপাচারের মাধ্যমে মণ্ডপে থাকা অন্যান্য দেবদেবী এবং তাঁদের বাহনদেরও প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
বাগবাজার সার্বজনীনের পুরোহিত তুলসীদাস মুখোপাধ্যায় জানান, ধরাধামে মায়ের আগমনে ব্যবহৃত প্রত্যেকটি যানের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে কিছু না কিছু শুভ ও অশুভ সঙ্কেত। যেমন গজে আগমন ও গমন দুটি ক্ষেত্রই শুভ। এটি ধরিত্রীকে সুজলা-সুফলা করে তোলার ইঙ্গিত দেয়। তবে এবার দেবীর আগমন-প্রত্যাগমন দুটিই হবে ঘোটকে। যার অর্থ ছত্রভঙ্গ, রোগজ্বালা বৃদ্ধি। দুর্গাপুজো যেহেতু সামাজিক উৎসব, তাই দেবী দুর্গার যান হিসেবে হাতি, ঘোড়া, নৌকো বা পালকিকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। যার উদ্দেশ্য ছিল, মর্ত্যের তৎকালীন যানবাহনকে সমান গুরুত্ব বা সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া। তুলসীবাবু জানান, শাস্ত্রমতে পশুরাজ সর্বশক্তির অধিকারী হলেও তিনি দেবী দুর্গার পদতলে বিরাজমান। দেবীর ডান পা থাকে সিংহের পিঠে এবং বাঁ পায়ের শুধুমাত্র বৃদ্ধাঙ্গুল থাকে মহিষরূপী অসুরের পিঠে। দেবীর এই দুই পা রাখার ভঙ্গিমার অর্থ কিন্তু এক নয়। বাহন সিংহের পিঠে পা রাখার অর্থ স্নেহ। অন্যদিকে, দেবীর শক্তির কাছে পরাজিত, তুচ্ছ অসুরকে আটকানোর জন্য মায়ের বাঁ পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলই যথেষ্ট। শাস্ত্র অনুযায়ী, সিংহের পিঠে দেবীর রণসাজ তাঁর ঐশ্বর্য বা তেজের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু মা দুর্গা যখন মর্ত্যে আসছেন, তিনি তখন বাঙালির ঘরের মেয়ে উমা। দেবীর সঙ্গে রয়েছে তাঁর সন্তানাদি এবং বাহনরা। মা মেনকার কাছে দেবীর রূপ কন্যাস্বরূপা এবং জগতের কাছে তিনি মাতৃস্বরূপা। মর্ত্যে দেবীর এই রণসাজ ঐশ্বর্যের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং স্নেহময়ী বা মাধুর্যের রূপেই বিরাজমান তিনি। তাই দেবীর আগমন-প্রত্যাগমনের যান ধরাধামের সাধারণ আর পাঁচটি যানের মতোই। তবে সৃষ্টির পাশাপাশি লয় না থাকলে বিশ্বের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। তাই গজের পিঠে আগমনের ফল শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা, আর দোলার ফল মড়ক। কিন্তু মর্ত্যে তো যুদ্ধের ব্যাপার নেই, তাহলে দেবীর হাতে ত্রিশূল কেন? কারণ হিসেবে তুলসীবাবু জানান, মর্ত্যে আগমনকালে দেবীর সঙ্গে তাঁর সন্তানাদি রয়েছেন। তাঁদের এবং সন্তানতুল্য সমস্ত মানবজাতিকে এই জগতের খল, কপট ব্যক্তিদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই দেবীর এই রণসাজ।