ধনাগম যোগটি অনুকূল। দুপুর থেকে কর্মের বাধা মুক্তি ও উন্নতি। শরীর-স্বাস্থ্য সমস্যার যোগ। ... বিশদ
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পদধূলিধন্য এই পুরীধাম। নানা নামেও পরিচিত এই তীর্থস্থান। বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন মানুষের কাছে নীলাচল, নীলগিরি, শ্রীক্ষেত্র, পুরুষোত্তমক্ষেত্র, জগন্নাথধাম প্রভৃতি নামে পরিচিতি পায় পুরী।
সমুদ্র আর বিস্তীর্ণ সোনালি বালুকাবেলার আকর্ষণ তো আছেই। কিন্তু পুরীর মূল এবং সর্বাধিক পরিচিতি জগন্নাথ মন্দিরের জন্যই।
কিংবদন্তি ও প্রচলিত কাহিনি অনুসারে, সূর্যবংশীয় রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বপ্নাদিষ্ট হলেন সমুদ্রতটে ভেসে আসা এক বিশেষ কাষ্ঠ খণ্ড দিয়ে দেবমূর্তি নির্মাণ করে সেই বিগ্রহকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই মতো সাগরে ভেসে এল কাষ্ঠখণ্ড। এবার রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন চিন্তিত হয়ে পড়লেন এই ভেবে যে, কে আছেন এমন দারুশিল্পী। যাঁকে দিয়ে তিনি নির্মাণ করাতে পারেন দেব বিগ্রহ? তিনি যখন উপযুক্ত দারুশিল্পীর খোঁজ করছেন, ঠিক সেই সময়ই এক রহস্যময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তাঁর সামনে উপস্থিত হলেন যিনি এই বিগ্রহ নির্মাণে প্রস্তুত। কিন্তু তাঁর শর্ত, কয়েকদিন সময় তাঁকে দিতে হবে এবং সেই সময়সীমায় তাঁকে বিরক্ত করা যাবে না। রাজা এই শর্তে রাজি তো হলেন, কিন্তু প্রতিদিনই তিনি কৌতূহলী হয়ে উঠতেন কাজ কতদূর এগল তা জানার জন্য। যে রুদ্ধ কক্ষে শিল্পী বিগ্রহ নির্মাণ করেছিলেন সেই কক্ষের ভিতর থেকে কাজ করার শব্দ অবশ্য শোনা যেত। কয়েকদিন এইভাবে কাজ চলার পর রাজা আর কৌতূহল সম্বরণ করতে না পেরে কক্ষের দরজার বাইরে এসে দাঁড়ান, ঠিক সেই মুহূর্তেই কাষ্ঠ খোদাইয়ের শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। রাজা কক্ষে প্রবেশ করেন এবং অবাক হয়ে দেখেন, শিল্পী উধাও হয়ে গিয়েছেন। এদিকে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি তখনও অসমাপ্ত। মূর্তির হাত-পা গড়া তখনও বাকি। রাজা বুঝতে পারেন যে ওই শিল্পী আর কেউ নন, স্বয়ং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। কাজে বাধা সৃষ্টি করার জন্য অনুতপ্ত হন রাজা। ঠিক সেই সময় রাজার সামনে আবির্ভূত হন দেবর্ষি নারদ। অনুতপ্ত রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে তিনি বলেন যে, এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তি পরমেশ্বরের এক রূপ বলে জগতে পূজিত হবে।
এ হল এক জনপ্রিয় প্রচলিত কাহিনি। তবে পুরীর মন্দির তৈরি নিয়ে বিভিন্ন রকম অভিমত রয়েছে। কারও কারও মতে, এই মন্দির নির্মাণ করেন রাজা যযাতি কেশরী। কেউ কেউ বলেন, রাজা অনঙ্গভীমদেব এই মন্দিরের নির্মাতা। তবে অধিকাংশ মানুষের মত, দ্বাদশ শতকে গঙ্গা রাজবংশের রাজা অনন্তবর্মা চোডগঙ্গা দেব (১১১২-১১৪৮ খ্রিস্টাব্দ) এই মন্দিরের নির্মাতা।
প্রায় ২১৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট জগন্নাথ মন্দিরটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৬৬৫ এবং প্রস্থে ৬৪০ ফুট। চারদিকে প্রবেশদ্বার। এগুলি হল— সিংহদ্বার, ব্যাঘ্রদ্বার, হস্তীদ্বার ও অশ্বদ্বার। মন্দিরের প্রধানদ্বার সিংহদ্বারের রক্ষক জয় ও বিজয়। মূল প্রবেশপথের সামনে রয়েছে অরুণস্তম্ভ নামে এক স্মৃতিস্তম্ভ। ২২টি ধাপ অতিক্রম করে পৌঁছতে হয় মন্দির প্রাঙ্গণে। মন্দিরের মূল দেবতা জগন্নাথ আর তাঁর সঙ্গে রয়েছেন বলরাম ও সুভদ্রা। এছাড়াও এই মন্দির চত্বরেই রয়েছে আরও কিছু মন্দির। তারমধ্যে বিমলাদেবী, মঙ্গলাদেবী, বিশ্বনাথ, রাধাকৃষ্ণ, গণেশ, রামচন্দ্র, জয়-বিজয়, ক্ষেত্রপাল, মার্কণ্ডেশ্বর অন্যতম। মূল মন্দিরে উঁচু বেদির উপর অবস্থান করছেন জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা। পাশে রয়েছে সুদর্শন চক্র। বাঁদিকে রয়েছে সোনার লক্ষ্মী আর ডানদিকে আছে রুপোর সরস্বতী মূর্তি। পিছনে নীলমাধব।
মন্দিরের উত্তরে বৈকুণ্ঠ বাগান। নবকলেবরের সময়ে এখানে জগন্নাথ দেবের পুরনো বিগ্রহটিকে সমাধিস্থ করে নতুন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়। করোনা অতিমারীর প্রকোপে পড়ে এ দেশের অন্যান্য মন্দিরের মতো পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের দরজাও বন্ধ হয়ে যায়। গত বছর মার্চ মাস থেকে বন্ধ হয়ে যায় মন্দির। তারপর কেটে যায় সুদীর্ঘ প্রায় ৯ মাস। অবশেষে আপামর পর্যটক এবং পুণ্যার্থীর মনোবাসনা পূর্ণ করে গত ২৩ ডিসেম্বর’২০২০ মন্দিরের দ্বার খুলে দেওয়া হয়। মন্দির কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন মন্দির খোলার প্রথম সপ্তাহ অর্থাৎ ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ পর্যন্ত কেবলমাত্র স্থানীয় দর্শনার্থীদের জন্যই মন্দির খোলা থাকবে। বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকবে। দর্শনার্থীর ভিড় এড়াতে জানুয়ারির ১ ও ২ তারিখ মন্দির সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। ৩ জানুয়ারি থেকে সর্বসাধারণের জন্য মন্দিরদ্বার উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছে। তবে অবশ্যই স্বল্প সংখ্যক দর্শনার্থীকে সবরকম কোভিড সতর্কতা মেনে মন্দিরে প্রবেশ করতে হচ্ছে।
নিউ নর্মালে সবকিছুর মতোই পুরী মন্দিরের কাজকর্মও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। বর্তমানে সম্পূর্ণ না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আবার আগের মতো জমজমাট হয়ে উঠেছে পুরীর জগন্নাথ মন্দির। বর্তমানে প্রচুর পুণ্যার্থী প্রতিদিন মন্দিরে আসছেন, বিগ্রহ দর্শন করছেন এবং স্বাভাবিক নিয়মেই পুজো দিচ্ছেন।
পুরী মন্দিরের দীর্ঘদিনের পাণ্ডা ভীমসেন ছাপ্পান্নভোগীর পুত্র বাবু পাণ্ডা দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে এই মন্দিরে পুণ্যার্থীদের পুজো দেওয়াতে সহযোগিতা করছেন। নিউ নর্মাল প্রসঙ্গে বাবু পাণ্ডার বক্তব্য, ‘মন্দিরে এখন আগের মতোই ভক্ত সমাগম হচ্ছে। তবে কয়েকটি বিধি নিষেধ মেনে চলার কথা বলা হয়েছে মন্দির কমিটির তরফে। তারমধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে মন্দিরে প্রবেশ করা, বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহার করা প্রভৃতি। ব্যবস্থা করা হয়েছে স্যানিটাইজেশনেরও।’ রাজবাড়ির কাছ থেকে মন্দির পর্যন্ত গ্র্যান্ড রোডের উপর ব্যারিকেড করে দেওয়া হয়েছে। এই ব্যারিকেডের মধ্যে দিয়ে কেবলমাত্র মূল দরজা দিয়েই দর্শনার্থীরা প্রবেশ করতে পারবেন মন্দিরে। বাইরের কোনও জিনিস, মিষ্টি বা পুজোর সামগ্রী নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মন্দিরের নির্দিষ্ট কাউন্টারে অর্থ জমা দিয়ে মন্দির থেকেই প্রসাদ বা ভোগ নিতে হচ্ছে। আর মন্দির প্রাঙ্গনেই বিক্রি হচ্ছে ফুল, মালা প্রভৃতি। সেখান থেকেই কিনতে হচ্ছে ওই সমস্ত পুজো সামগ্রী। এই সামান্য কিছু নির্দেশিকা পালন করলেই পুণ্যার্থীরা যেতে পারছেন জগন্নাথ দর্শনে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আবার নতুন উদ্যোমে শুরু হয়েছে পর্যটন ব্যবসা। খুলে গিয়েছে প্রায় সব হোটেলই। পর্যটকও আসছেন যথেষ্ট সংখ্যায়।
একইভাবে দীর্ঘকাল বন্ধ থাকার পর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে রেল পরিষেবা। কলকাতা থেকে পুরী যাওয়র সব ট্রেন না চললেও কিছু ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। এই মুহূর্তে হাওড়া-পুরী স্পেশাল ও শিয়ালদা-পুরী স্পেশাল ট্রেন চলছে। আশা করা যায় খুব শিগগিরই সমস্ত ট্রেনই চলাচল শুরু করবে এবং বাঙালির অন্যতম প্রিয় পর্যটনকেন্দ্র পুরী আবার আগের মতো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।