নিজস্ব প্রতিনিধি, নয়াদিল্লি: ডিজিটাল যুগে নতুন পেশা এবং পরিচয়ের নাম ইউটিউবার অথবা ইনফ্লুয়েন্সার। একটি স্মার্ট ফোন এবং তাতে ডেটা রিচার্জ থাকলেই হল। সাধারণ গৃহবধূ অথবা পড়ুয়া, সাবালক অথবা নাবালক, যে কেউ একা কিংবা দল বেঁধে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানাবিধ বিষয় বা কন্টেন্ট প্রদর্শন করে জনপ্রিয় হচ্ছে এবং আয়ও করে চলেছে। লাগামহীন ডিজিটাল কন্টেন্টে ভেসে যাচ্ছে ইউটিউব, ফেসবুক, এক্স, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি। কিন্তু আর নয়, আসছে নয়া আইন! ইচ্ছে হল আর রাতারাতি রাজনীতি, সরকারি নীতি, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা পোস্ট করে দিলাম, এমনটা চলবে না। সরকার সেটিকে বেফাঁস মনে করলেই সেই নতুন আইনের জালে জড়িয়ে পড়বেন পোস্টদাতা। অর্থাৎ কেন্দ্রের রোষনজরে এবার আম জনতাও। শুক্রবারই সংসদে এই ইস্যুতে সরব হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। বিষয়টি চলছে জোর বিতর্ক।
কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স অর্থাৎ রাজনীতি, সমাজ ইত্যাদি সমকালীন যে কোনও বিষয় নিয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রদর্শন করা হলে, সেই ব্যবহারকারী ও তার চ্যানেলকে কেন্দ্রীয় ব্রডকাস্টিং আইনের বিধিনিষেধের আওতায় নিয়ে আসতে চাইছে মোদি সরকার। নতুন ব্রডকাস্টিং বিলের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। সেই বিল খতিয়ে দেখছে কিছু বিশেষজ্ঞ মহল। তবে অত্যন্ত গোপনে এবং সতর্কভাবে, যা বেনজির। যে কোনও আইন প্রণয়নের আগে প্রথম পদক্ষেপ, বিল তৈরি করা। সেই বিলের খসড়া সেব্যাপারে বিশেষজ্ঞ মহলের মধ্যে বিলি করা হয়, যাতে তারা মতামত দিতে পারে। এমনকী বহু ক্ষেত্রে মন্ত্রকের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সরাসরি দেশবাসীর কাছেই মতামত চাওয়া হয়। সব মহলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা সেরে প্রয়োজনে সংশোধন করে মন্ত্রিসভার বৈঠকে পাশ করানো হয় সেই বিল। তারপর পেশ করা হয় সংসদে। কিন্তু নতুন ব্রডকাস্টিং খসড়া বিল নিয়ে চলছে প্রবল গোপনীয়তা। আর সেটির মূল উপজীব্য জানাজানি হতেই দেশজুড়ে বাড়ছে আশঙ্কা এবং প্রতিবাদ। তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে এবার সরাসরি আইনের বেড়াজালে আনার লক্ষ্যেই এই বিল। কারণ, এই বিল পাশ হয়ে গেলে ইউটিউবার, ইনফ্লুয়েন্সার, ইউটিউবে চলা স্থানীয় স্তরের ডিজিটাল মিডিয়া, প্রতিটি অ্যাকাউন্টকেই সরাসরি নিয়ন্ত্রণে বা সেন্সরশিপের অধীনে নিয়ে আসা যাবে। সোজা কথায়, সরকার বিরোধী কোনও মন্তব্য কিংবা বক্তব্যের উপর চলবে আইনত নজরদারি।
এদিনই রাজ্যসভায় বিষয়টি নিয়ে সরব হন তৃণমূল এমপি জহর সরকার। লিখিত প্রশ্নে তিনি জানতে চান, এরকম কোনও বিল আসছে কি না, যেখানে ডিজিটাল সাংবাদিকতা এবং কন্টেন্ট ক্রিয়েশনের ফারাক কমিয়ে আনা হচ্ছে? এবং কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স তথা সংবাদের সংজ্ঞা অনেক সম্প্রসারিত করা হচ্ছে? সরকারের হয়ে তথ্য-সম্প্রচার রাষ্ট্রমন্ত্রী এল মুরুগান অবশ্য সরাসরি প্রশ্নগুলির উত্তর দেননি। রহস্য জিইয়ে রেখে বলেছেন, ‘ড্রাফট ব্রডকাস্টিং সার্ভিসেস (রেগুলেশন) বিল তৈরি হয়েছে। আলাপ আলোচনার জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে বিলি করা হয়েছে।’ জহরবাবুর অভিযোগ, সংসদ জানে না, অথচ কর্পোরেট ও সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে বিল চলে গেল?
এই বিল পাশ হয়ে গেলে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স নিয়ে সামান্যতম প্রচার করা যে কোনও কন্টেন্ট ক্রিয়েটরকে একমাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নিজেদের অ্যাকাউন্টের অস্তিত্ব জানাতে হবে। পাশাপাশি নিজেদের অর্থে গঠন করতে হবে একটি কন্টেন্ট ইভ্যালুয়েশন কমিটি। তারা ভিডিও অথবা অনুষ্ঠান আগাম দেখে ছাড়পত্র দিলে তবে তা প্রচার করা যাবে। অর্থাৎ সরকার যদি মনে করে আইন অথবা বিধি ভঙ্গ হয়েছে, সেক্ষেত্রে ওই কমিটির সদস্যরাও সমান দায়বদ্ধ হবে। সরকারের দাবি, কন্টেন্ট ক্রিয়েশনের নামে লাগামছাড়া প্রচার ও প্রদর্শন চলছে। অনৈতিক এবং বিপজ্জনক প্রচারে যাতে সমাজে অস্থিরতা ও অশান্তি না ছড়ায় তাই এই বিধিনিয়ম।
বিলে কী বলা হচ্ছে? যে কোনও ওটিটি প্ল্যাটফর্মকে যেভাবে বিধিনিষেধের আওতায় আনা হয়েছে, সেই একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে ডিজিটাল কন্টেন্টেও। বিলে প্রবেশ করানো হয়েছে, ‘টেক্সট’, ‘অডিও’, ‘ভিস্যুয়াল’ ইত্যাদি শব্দ। অর্থাৎ সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ!