জীবন এক মহাসমুদ্র। আনন্দ, ভালোবাসা, আর আতঙ্কের। আমরা তাতে প্রতিনিয়ত ভেসে চলেছি। এই সমুদ্রের গভীরতা ভারী সুন্দর, আর ততটাই ভয়ের। লড়াই চলছে আমাদের নিরন্তর... প্রচণ্ড শক্তিশালী ও প্রতি মুহূর্তে বদলাতে থাকা স্রোতের সঙ্গে। এই যুদ্ধ বেঁচে থাকার। কারণ, ভালোবাসা, আনন্দের পাশাপাশি এই সাগরে রয়েছে মৃত্যুভয়, খিদে, হারানোর যন্ত্রণা, আর ব্যর্থতাও। এটাই জীবন। মহাসমুদ্রে সাঁতরে যাওয়া। সুন্দর, কিন্তু ভয়াবহ। কারণ, এই মহাসমুদ্র থেকে কেউ বেঁচে ফেরেনি। ফিরবেও না।
মনে গেঁথে থাকা এই আতঙ্ক জয় করার সাহস কার আছে? কারই বা রয়েছে জীবনের এই মহাসমুদ্র থেকে সত্যের মুক্তো তুলে আনার মতো চোখ? উত্তর একটাই—তিনি একজন হিন্দু। এটা বুঝেছি বলেই জোর দিয়ে বলতে পারি, হিন্দুধর্মকে সংস্কার এবং কিছু রীতি-নীতি দিয়ে বিচার করা মানে, তাকে স্রেফ ভুল বোঝা। নির্দিষ্ট একটা দেশ বা ভৌগোলিক সীমায় একে বেঁধে রাখা যায় না। হিন্দুধর্মের ব্যাপ্তি সীমান্ত ছাড়িয়ে। যতদূর মানুষের ভাবনা পৌঁছতে পারে, ততদূর। জীবনে আতঙ্কের মুহূর্তগুলোর সঙ্গে আমাদের যে গভীর সম্পর্ক, তাকে বোঝা... তার নিরসন করার নামই হিন্দুধর্ম। এ হল সত্যকে উপলব্ধি করার একটা পথ, যা সবার জন্য খোলা। যে কেউ চাইলে হাঁটতে পারে, ছুঁতে পারে সত্যকে।
একজন প্রকৃত হিন্দু নিজেকে তো বটেই, জীবনের এই মহাসমুদ্রকেও ভালোবাসা, স্নেহ এবং শ্রদ্ধার নজরে দেখেন। কারণ তিনি জানেন, আমরা প্রত্যেকে এই একই সমুদ্রে ভাসছি, ডুবছিও। জন্ম থেকে মৃত্যু, একটিই চক্রে বাঁধা। সুখ আছে, দুঃখও। সাঁতরে পার হওয়ার চেষ্টা করছি আমরা সবাই। একসঙ্গে। আশপাশে। প্রকৃত হিন্দু এই লড়াইয়ে যাঁদের অসুবিধায় পড়তে দেখেন, রক্ষা করেন তাঁদের প্রত্যেককে। সতর্ক থাকেন তিনি... ক্ষীণ আর্তনাদ, কাতর ডাক তাঁর কান এড়িয়ে যায় না। অন্যকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করে যাওয়ার এই কর্ম বা কর্তব্যই একজন প্রকৃত হিন্দুর কাছে ‘ধর্ম’। সত্য এবং অহিংসার চশমায় তিনি বিশ্বের প্রতিটি অদৃশ্য সমস্যা শোনেন, সেই মতোই তাঁর কর্ম।
আতঙ্ক সঙ্গী করে বাঁচাই যে জীবন। তার গভীরতা বোঝেন একজন প্রকৃত হিন্দু। শত্রুর প্রতি ভয়কে তিনি বদলে দেন বন্ধুত্বে। প্রকৃত হিন্দু কখনও পরিস্থিতির শিকার হন না, হতে পারেন না। ভয়কে মাথার উপর চড়ে বসতে দেওয়া তাঁর চরিত্র নয়। হেরে যাওয়ার আতঙ্কে ঘৃণা বা হিংসাকে তিনি অস্ত্র করেন না। জীবনের মহাসমুদ্র মন্থন করেই উঠে আসে জ্ঞানের অমৃত, আর প্রকৃত হিন্দু তা জানেন। ব্যক্তি নয়, সবটাই সমষ্টির ফসল। তিনি জানেন, প্রাপ্ত জ্ঞানের সমুদ্র তাঁর একার সম্পত্তি নয়। স্রোতে বয়ে যাওয়া প্রতিটা মুহূর্ত নতুন ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। আর সঙ্গে শিক্ষা। কখনও সে থমকে যাচ্ছে না। শেখার কোনও শেষ নেই। প্রকৃত হিন্দু তা জানেন। তাই মনের দরজা তাঁর কখনও বন্ধ হয় না। জীবনের স্রোত থেকে, কেটে যাওয়া প্রতিটা মুহূর্ত থেকে প্রতিনিয়ত তিনি শিক্ষা নেন। বিনয়ের সঙ্গে। তাঁর ভালোবাসা প্রত্যেক জীবের জন্য। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেককে তিনি গ্রহণ করেন। হৃদয়ের গভীর থেকে উপলব্ধি করেন, এই সমুদ্র সবার। নিজের নিজের পথ খুঁজে নেওয়ার অধিকার সবার আছে। প্রকৃত হিন্দু কারও উপর কোনও ধারণা চাপিয়ে দেন না। প্রত্যেক পথের গুরুত্ব অপরিসীম। আর প্রত্যেকটি পথই তাঁর পথ।