নিজস্ব প্রতিনিধি, ঝাড়গ্রাম: ঝাড়গ্ৰাম শহর থেকে দহিজুড়ি হয়ে শিলদা যাওয়ার পথে কাকো গ্ৰাম। বিনপুর-২ ব্লকের এই গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে ৮৬ বছর বয়সেও কাজ করে চলেছেন নন্দলাল পাল। এই শিল্পের সম্ভবত শেষ প্রতিনিধি তিনি। লোকজ শিল্পের ঐতিহ্যময় ধারা তাঁর হাত ধরেই আজও টিকে আছে। তাঁর দক্ষতায় এঁটেল মাটি রূপ পায় ঘোড়া, হাতিতে। সেই ছোট বয়সে বাপ, ঠাকুরদার কাছে হাতি, ঘোড়া, ধুনুচি, প্রদীপদানি বানানোর কৌশল শিখেছিলেন। প্রথমে ভালো এঁটেল মাটি সংগ্ৰহ করতে হয়। মাটি তৈরির পর ধাপে ধাপে মাথা, পেট, কোমর, গলা, পা লম্বা সিলিন্ডারের আকারে আলাদা করে তৈরি করতে হয়। দ্বিতীয় ধাপে জোড়া লাগানোর কাজ চলে। বাঁশপাতি, পিটনি দিয়ে এরপর গড়নের কাজ করতে হয়। শেষ ধাপে হয় নকশার কাজ। আজও চালিয়ে যাচ্ছেন ছোটবেলায় শেখা সেই কাজ।
নন্দলালের তিন ছেলেই অন্য পেশায় যুক্ত। তবে মেজো ছেলে ও বউমা সুলেখা পাল বৃদ্ধকে সহযোগিতা করেন। জঙ্গলমহলের মানুষ আজও জঙ্গল, পাহাড়, দেবতাদের থানে পুজো দিতে তাঁর তৈরি নকশা কাটা ছোট ঘোড়া, হাতি নিয়ে যান। অন্য পুজো পার্বণে, ধুনুচি, প্রদীপদানি, মাটির হাড়ি কেনাবেচা হয়। শিল্পরসিক পর্যটকরাও তাঁর কাজের খোঁজ করেন। তাঁর তৈরি শিল্প সামগ্ৰী কিনে নিয়ে যান। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শিল্পের চাহিদা কমে আসছে। কুম্ভকার পরিবারের তরুণ প্রজন্ম এই পেশায় আর আসছে না। যার জেরে হারিয়ে যেতে বসেছে এই শিল্প। নন্দলালের বউমা সুলেখা পাল বলেন, বিয়ের পর শ্বশুর মশাইয়ের কাছেই মাটির ঘোড়া, হাতি, প্রদীপদানি তৈরির কাজ শিখেছি। বয়সের ভারে তিনি আগের মতো কাজ করতে পারেন না। তবে নেশার টানে এখনও কাজ করে চলেছেন। সংসারের কাজ সামলে মাটি তৈরির কাজ করে দিই। জোড়া লাগানো, পিটনি, নকশার কাজ উনি করেন। পুজো পার্বণে গ্ৰামীণ এলাকার মানুষ এইসব জিনিস কিনে নিয়ে যান। পর্যটকরাও কেনেন। বাবার কাজের তারিফও করেন। তবে এই কাজের জন্য প্রশাসনের থেকে আর্থিক সহযোগিতা পাওয়া যায় না। এই শিল্পকে বাঁচানোর লক্ষ্যে কুম্ভকার সংগঠনের তরফে কিছুদিন আগে সম্মেলন হয়েছে। শ্বশুর মশাইকে সে বিষয়ে তাঁরা জানিয়ে গিয়েছিলেন। তবে উনি না থাকলে কাকো গ্ৰামের এই শিল্প হয়তো চিরতরে শেষ হয়ে যাবে। মেজো ছেলে শ্যামাপদ পাল বলেন, এই শিল্পের আর বাজার নেই। বাবার কাজে মাঝেমধ্যে হাত লাগালেও আমি মূলত কাঠের কাজ করি। বাবা যেভাবে হাতি, ঘোড়া তৈরি করেন, আমাদের পক্ষে সেরকম সূক্ষ্ম কাজ করা সম্ভব নয়। কাকো গ্ৰামের দেশজ শিল্পের উনিই মনে হয় শেষ প্রতিনিধি। ঝাড়গ্ৰামের কুম্ভকার সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রামকৃষ্ণ প্রধান বলেন, এই শিল্প দীর্ঘদিন ধরে ধুঁকছে। নতুন প্রজন্মের সদস্যরা এই কাজ করছে না। কুম্ভকার সমাজের দাবিদাওয়া নিয়ে কিছুদিন আগেই জেলায় সম্মেলন করা হয়েছে। প্রশাসনকে আমাদের দাবিদাওয়ার বিষয়টি দেখতে আবেদন করা হচ্ছে।-নিজস্ব চিত্র