বেনারসির নকশা ও রূপের নানারকম নিয়ে মতামত জানালেন বিশেষজ্ঞরা।
বাঙালি কন্যেদের কাছে আজও বিয়ে মানেই বেনারসি শাড়ি। কুমকুমে চন্দনে চর্চিত মুখে লাল বেনারসির সাজ আধুনিক যুগেও বাঙালি মেয়েদের খাস পছন্দ। বিবাহকালে নববধূটির পরনে লাল জরির ফুল তোলা বা বুটিদার বেনারসি তাই বাঙালি বিয়ের চিরকালের অঙ্গ। বেনারসির ইতিহাস অবশ্য আরও খানিক সুদূরপ্রসারী। মোগল সম্রাটরা নাকি তাঁদের রানি ও প্রেয়সীদের এই পোশাকে সাজাতে পছন্দ করতেন। সেই সময় বেনারসির শাড়িতে সোনা ও রুপোর জরি ব্যবহার করা হতো।
যুগ যতই পাল্টেছে বেনারসি শাড়ির নকশা এবং ধরনেরও নানা বদল এসেছে। বেনারসির ভারী বুনট পাল্টে হালকা হয়েছে। তাছাড়া কাপড়ের ধরনও বদলে গিয়েছে। এখন আর বেনারসি মানেই একগাদা জরি দেওয়া ভারী শাড়ি নয়। বিয়ে ছাড়া অন্যান্য অনুষ্ঠানে পরার মতো ডিজাইনও এখন বেনারসিতে এসেছে। এই বিষয়ে প্রিয়গোপাল বিষয়ীর তরফে সৌমিত্র দাস জানালেন, ‘বিয়ের দিন বাঙালি কনেরা লাল বা লালচে বেনারসিতেই মূলত সাজতে চায়। কিন্তু অনেকে আবার বেনারসির বিকল্প শাড়িও খেঁাজেন। সেই ক্ষেত্রে যে শাড়িটি ক্রমশ বাঙালি নববধূর খুবই প্রিয় হয়ে উঠছে তা হল বালুচরি। আধুনিকাদের পছন্দ অনুযায়ী বালুচরিও নিজের ধরন ও নকশায় খানিকটা বদল এনেছে। আগে যেমন রামায়ণ মহাভারতের গল্পের চিত্ররূপ সুতোর নকশায় বোনা হতো বালুচরি শাড়ির গায়ে, এখন তার পাশাপাশি অনেকেই বেনারসির মতো ফুল, কলকার নকশাতেও বালুচরি শাড়ি সাজিয়ে তুলছেন।’
বেনারসির নকশার নানারকম বলতে গিয়ে বেনারসী টেক্সটোরিয়ামের তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, ‘জলা জংলা নকশাই বিয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। তাছাড়া বুটির নানারকমও রয়েছে এই শাড়িতে। কেউ গায়ে ছোট ফুলের নকশায় বুটি পছন্দ করেন। কেউ বা একটু কলকা নকশা চান। ফুলেল বুটিরও আবার ছোট বড় থাকে। অনেকে আঁচলে ঠাসা জরির কাজ পছন্দ করেন, গায়ে হালকা জরির কাজ চান। কেউ বা গোটা শাড়িতেই ভরাট জরি চান। তবে আধুনিকারা ভারীর বদলে একটু হালকা নকশার বেনারসিই বেশি পছন্দ করছেন। সেই অনুযায়ী কাতান বেনারসির বুননেরও বিভিন্ন ধরন তৈরি হচ্ছে। এখন সিংগল কাতান বেনারসিরই চল বেশি।’
বিয়ের শাড়িতে একটু ভারী কাজই ভালো লাগে, জানালেন তাপসবাবু। তাঁর মতে জলা জংলা নকশার বেনারসি বিয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত। এই ধরনটি সম্পর্কে একটু বিশদে বোঝালেন তিনি। বললেন, বেনারসির এই ধরনটায় শাড়ির সারা গায়ে জালের মতো জরির কাজ থাকে। সেই নকশায় অনেকে ফুল লতা পাতা পছন্দ করেন, কেউ বা তাতে একটা জিওমেট্রিক প্যাটার্ন চান। অর্থাৎ গোল, ত্রিভূজ ইত্যাদির মাধ্যমে জরির কাজটা সারা শাড়িতে ছড়িয়ে থাকবে। এই যে জালের মতো জরির নকশা, এটা সবসময়ে একে অপরের সঙ্গে লেগে থাকে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন একঢালা জরি দিয়ে কাজ করা হয়েছে। বুটিদার বেনারসির থেকে এই ডিজাইনটা আলাদা কারণ বুটির ক্ষেত্রে তা একে অপরের থেকে আলাদা থাকে। আর জংলা জিজাইনে তা একে অপরের সঙ্গে লেগে থাকে।
বেনারসির নকশায় মীনাকারি কাজ এখনও অনেকেই চাইছেন, জানালেন সৌমিত্রবাবু। মূলত নীল, সবুজ আর লাল রং এই মীনাকারি নকশা জনপ্রিয়। এই প্রসঙ্গে ইন্ডিয়ান সিল্ক হাউসের ডিজাইনার অদিতি ভার্মা বললেন, ‘একটা সময় ছিল যখন মীনের ডিজাইন বিয়ের গয়নায় জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল। আবারও সোনার গয়নায় মীনাকারি নকশা ফেরত আসছে। আর সেই সঙ্গেই বেনারসি শাড়িতেও মীনের কাজের কদর বাড়তে শুরু করেছে। মীনের গয়নায় যে ধরনের রং মূলত ব্যবহার করা হয় সেই রঙের মীনের কাজই শাড়িতেও চায় নববধূরা। সেই মতোই লাল, সবুজের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি অনেকে নীল রংটিও চাইছেন শাড়ির মীনেতে।’
বেনারসির নকশার পর এবার একটু রং প্রসঙ্গে আসা যাক। এক্ষেত্রে কিন্তু সকলেই একবাক্যে নতুন যুগের পছন্দ হিসেবে জাম রংকেই তুলে ধরলেন। সৌমিত্রবাবু বললেন, জাম রঙের নানা শেড এখনকার প্রজন্ম পছন্দ করছেন। কেউ হালকা ওয়াইন শেড বাছছেন কেউ বা গাঢ় বার্গেন্ডির দিকে ঝুঁকছেন। তাপসবাবুও জানালেন, বিয়ের শাড়িতে একটু গাঢ় রংই আধুনিকারা চান। লাল বা মেরুনের চাহিদা এক্ষেত্রে চিরকালীন। কিন্তু পাশাপাশি যে রংটি এই মুহূর্তে উঠে আসছে আধুনিকাদের পছন্দের তালিকায় তা হল মেরুন ও লালের মিশেলে তৈরি ডার্ক ওয়াইন কালার। অদিতি বললেন, একটা সময় ছিল যখন বেগুনি রঙের প্রচণ্ড চাহিদা হয়েছিল বেনারসি শাড়িতে। সেই চাহিদা এখন একবারেই নেই। বরং শট কালার বা ডুয়াল টোনের বেনারসি এখন অনেকেই পছন্দ করছেন। তার মধ্যে ময়ূরকণ্ঠী রঙের চাহিদা খুবই বেশি। পিংক আর নীলের মিশ্রণটিও ভালোই চলছে। রানি পিংকের সঙ্গে ম্যাজেন্টার মিলমিশে তৈরি হচ্ছে একেবারেই আনকোড়া একটা রং। তাতে সোনালি বুটি বা জালের কাজ থাকছে।
শাড়ির পাশাপাশি জরির রঙের দিকেও খেয়াল করছেন এ যুগের আধুনিকারা। তাদের পছন্দে সোনালি জরির পাশাপাশি কপার জরিও উঠে এসেছে বেনারসি শাড়িতে। এক্ষেত্রেও বিয়ের গয়নার বড় ভূমিকা থাকে, জানালেন সৌমিত্র দাস। তাঁর কথায়, ‘বিয়ের গয়নায় দক্ষিণী নকশার প্রচলন শুরু হওয়ার পাশাপাশিই বেনারসি শাড়িতে কপার জরির কারুকাজ শুরু হয়। আজকাল স্বর্ণালঙ্কারে কারিগররা টেম্পল ডিজাইন করছেন। সেই ধরনের গয়নায় একটা পুরনো লুক, অ্যান্টিক ফিনিশ থাকছে। গয়নার এই ধরনটির সঙ্গে কপার বা তামাটে জরির কাজ খুলছে ভালো। সেই অনুযায়ীই মেয়েরা বেনারসিতে কপার জরির কাজ চাইছেন।
কাতান বেনারসি ছাড়াও বেনারসির আরও নানা ধরন এ যুগের আধুনিকাদের পছন্দ। তার মধ্যে সবার আগে আসে তসর বেনারসি। বউয়ের মায়ের জন্য এই শাড়িটিই হিট চয়েস। হালকা শাড়ির জমিতে একটু দূরত্ব বজায় রেখে জরির ফুল তোলা নকশা, নীচের দিকের পাড়ে ভরাট জরির কাজ আর উপর দিকের পাড়টা তুলনায় সরু। বিভিন্ন রঙে এই বেনারসি আধুনিক প্রজন্মের মা কাকিমাদের খুবই মনে ধরছে। তসর বেনারসির ক্ষেত্রে আঁচলেও ঠাসা জরি থাকছে। সাধারণত এই শাড়িতে পাড় আঁচলে কনট্রাস্ট রং থাকে। ব্লাউজও সেই অনুযায়ী কনট্রাস্টেই ডাই করা হয়। বেনারসিতে কিন্তু তেমনটা সবসময় হয় না, জানালেন সৌমিত্রবাবু। সেখানে সাধারণভাবে শাড়ির রঙেরই ব্লাউজ পিস থাকে। অনেক সময় কাস্টমাইজড বেনারসি বানানো হয় যাতে দু’ধরনেরই ব্লাউজপিস রাখা হয়। একটা ব্লাউজ শাড়ির রঙে ডাই করা হয়, অন্যটা হয় কনট্রাস্ট রঙে রাঙানো। তবে এই ধরনের বেনারসিগুলো তুলনায় দামি হয়।
বেনারসির আর একটা ধরন হল জর্জেট বেনারসি। এটা কনের বোন, দিদি, বউদি স্থানীয়দের জন্যই আদর্শ জানালেন তাপসবাবু। তাঁর কথায়, এই বেনারসিগুলো খুবই হালকা হয়। এতে জরি কাজের আধিক্য থাকে না। পাড় সরু হয় এবং আঁচলে একটু ভরাট কাজ থাকে। জর্জেট ছাড়াও শিফন বেনারসিও অল্পবয়সিদের কাছে ইদানীং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দূরে দূরে ছোট বুটিদার নকশায় এই বেনারসিগুলোর রূপ খুলে যায়। জর্জেট এবং শিফন দু’ক্ষেত্রে প্যাস্টেল শেডই শাড়িতে বেশি মানানসই। অনেকে কালো জর্জেট বা শিফন বেনারসিও কিনতে পছন্দ করেন। এই ধরনের বেনারসির সঙ্গে কনট্রাস্ট রঙের সিল্ক বা টিস্যু ব্লাউজ বেশি ভালো মানায়। একটু ডিজাইনার ব্লাউজও এক্ষেত্রে মন্দ লাগে না।