আবীর চট্টোপাধ্যায় যতটা স্বচ্ছন্দ ব্যোমকেশ বক্সী থেকে হালের পঙ্কজ সিনহার ভূমিকায়, ততটাই সচেতন তাঁর শরীরচর্চা ও স্টাইলিং নিয়ে। সাজসজ্জা থেকে ফিটনেস, কথা বললেন সবকিছু নিয়েই। শুনলেন অন্বেষা দত্ত।
সাম্প্রতিক ছবি ‘রক্তবীজ’-এর সাফল্যের পর সবার নজর এখন আপনার ফিটনেসের দিকে। আপনি কি এবার অ্যাকশন হিরো?
অ্যাকশন হিরোর রোল আমি আগেও করেছি। আর এই ফিটনেসের যে ডেলি রুটিন, তার অনেকটা কৃতিত্ব আমার বন্ধু সত্রাজিৎ সেনের প্রাপ্য। সঙ্গে আমার ট্রেনার, নতুন জিম তো আছেই। শরীরচর্চাটা অভ্যাসের মতো। আগেও ছিল। ২০১৬ সাল থেকে আমি নিয়মিত জিম করি। কিন্তু লকডাউনে একটু ছেদ পড়েছিল। তবে কোভিড পরবর্তী সময়ে আবার রুটিনে ফিরেছি। পুরো ব্যাপারটা শারীরিক চর্চায় আটকে থাকেনি, এটাকে মানসিক চর্চাও বলতে পারেন। কারণ কোভিড পরবর্তী ডিপ্রেশন, মানসিক চাপ, টেনশন, বিরক্তি, না পাওয়া এমন সবকিছুর সঙ্গে লড়াই করতে সাহায্য করেছে শরীরচর্চা। এটা আমার ক্ষেত্রে যেমন সত্যি, আমার বন্ধুদের ক্ষেত্রেও। তাই শরীরচর্চা এখন প্রয়োজন। আমি মনে করি যখন কোনও মানুষ শরীরচর্চা করতে পারছেন না বলে অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন, তখনই বোঝা যায় ওটা তার জীবনচর্চার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আর একটা বিষয় হল, শরীরচর্চা নিয়ে অনেক মিথ কাজ করে আমাদের মনে। বালজিং বাইসেপস করতে হবে বা অন্য কিছু, খাওয়াদাওয়া নিয়েও নানাবিধ ভ্রান্ত ধারণা। আমি কিন্তু সবই খাই। দরকার হচ্ছে পরিমিতি বোধ আর ধারাবাহিকতা। শরীরচর্চা করতে গিয়ে আমি এমন কিছু করব না যাতে মনে হয় খুব কষ্ট হচ্ছে। তাহলে সেটা তিন-চার দিনের বেশি করতেও পারব না।
আমি যখন ‘অবরোধ’ সিজন টু-এর শ্যুটিং করছিলাম তখন একটা মারাত্মক শিডিউলে কাজ করেছি। জম্মু কাশ্মীরের ঠান্ডায় একটা রাফ টেরেনের মধ্যে কাজ। সঙ্গে রিয়েল বন্দুক। এমন একটা চরিত্র করতে গিয়ে তখন বাস্তব জীবনের ওই মানুষগুলোর লাইফস্টাইল কাছ থেকে দেখেছি, শিখেছি। ওই হোমওয়ার্ক, ওই ফিটনেস ‘রক্তবীজ’-এও কাজে লেগেছে। এরপরে অ্যাকশনই শুধু করব, তা নয়। যেমন চরিত্র আসবে, করব। ফিটনেস নিয়ে আগেও কথা হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক ছবিটার চরিত্র, গল্প সব মিলে বিষয়টা চর্চায় এসেছে।
এরপর স্বপন কুমারের দীপক চ্যাটার্জি হয়েও স্টান্ট করছেন তো আপনি?
এই প্রোজেক্টে এমন অনেক কিছুই হয়েছে যা আমি আগে করিনি। মে মাসের গরমে লং ওভারকোট আর টুপি! এমন সব লোকেশনে শ্যুট হয়েছে, সচরাচর যেখানে হয় না। একটা ট্রলারের উপরে দাঁড়িয়ে আছি মাঝদরিয়ায়, যেটা টিজারে দেখা যাচ্ছে। পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য অনেক কিছু আউট অব দ্য বক্স করেছে। এই পাগলামিটা সাধুবাদযোগ্য। একটা বয়সের পরে আমরা সব হিসেব মেনে করি, সেটা থেকে সরে এসে এই ঝুঁকিটা নেওয়া দরকার। তার জন্য শারীরিক চ্যালেঞ্জ অবশ্যই ছিল। ওই গরমে ১৭-১৮ ঘণ্টা শ্যুট করা। এর জন্য কিন্তু শুধু দেখতে ভালো হলে হবে না। ভেতর থেকে ফিট থাকতে হবে। আসলে সেটাই দরকার। একইসঙ্গে প্রাণবন্ত লাগতে হবে। ফিটনেসের সঙ্গে মানসিক আনন্দটাও থাকতে হবে।
আপনি অভিনেতা, আপনাকে অনেক কিছু মেনটেন করতেই হয়। কিন্তু সাধারণ কর্পোরেট লাইফের চাপে মানুষ কীভাবে ফিটনেস রেজিম মেনে চলবে?
সবার আগে মিথগুলো ভেঙে দিতে হবে। আমাকে অনেকে এটা-ওটা খেতে দেখে অবাক হয়ে বলেন, এ বাবা আপনি এটা খেলেন! এটা হলে চলবে না। জীবনে সব কিছুর দরকার আছে। যেমন কেউ ভাবলেন, আমি বছরের পর বছর এগ রোল খেলাম না, কচুরি তরকারি খেলাম না। ওতে লাভ নেই। মানসিকভাবে ভালো থাকাটাও দরকার। আবার তা বলে কেউ যদি রোজ সকালে কচুরি তরকারি খায়, সেটা মুশকিলের। মোদ্দা কথা, জীবনে একটা ভারসাম্য রাখতে হবে। আমি হইহই করে এখন যদি চার ঘণ্টা ধরে ওয়ার্ক আউট করতে যাই, সেটাও শরীরের পক্ষে খারাপ। যারা অন্য পেশায় আছে, তাদের নিজেদের মতো রুটিন তৈরি করতে হবে। সেলিব্রিটি, খেলোয়াড় বা যাঁকেই আপনি ফলো করুন, জানবেন তার লাইফের ৫ শতাংশ আপনাকে দেখানো হচ্ছে। আপনি সেটা দেখে অন্ধের মতো ফলো করছেন। আপনার যিনি অনুপ্রেরণা, তিনি তাঁর কাজের প্রয়োজনে এবং তাঁর শরীরের ধাত মেনে সব কিছু করছেন। সেটা আপনার স্যুট নাও করতে পারে। আপনার শরীরের ধাত বা বংশানুক্রমে যেসব বৈশিষ্ট্য আপনার নিজস্ব, সেগুলো মেনে আপনাকে চলতে হবে। নিজের কাজের জন্য আমাদের প্রত্যেককে সুস্থ থাকতে হবে। অনেকে ভাবেন, রোজ ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করেছি বলে এক ঘণ্টা হাঁটতে পারব না। সব সপ্তাহে নিশ্চয়ই একই রকম চাপ থাকে না। তখনও হাঁটার চেষ্টা না করে ভাবলাম এবার একটু হালকা থাকি, আড্ডা মারি। আড্ডা দিন। কিন্তু শরীরচর্চাও করুন। হঠাৎ কিছু খাওয়ার ক্রেভিং হলে খান। তা বলে ক্রেভিং-এর নামে একটা গোটা ক্যাডবেরি খেয়ে ফেললে হবে না। ওটা ক্রেভিং নয়, লোভ!
পুরুষও আজকাল রূপচর্চায় পিছিয়ে নেই। ত্বকের যত্নে আপনি কী কী করেন?
এগুলো নিয়ে আমি আলোচনা করি না। আমাদের কাজটাই হল ম্যাজিক তৈরি করা। তার সবই আমি যদি বলে দিই বা দেখিয়ে দিই তাহলে আর ম্যাজিক রইল কোথায়? কিছু জিনিস অন্তরালে থাকা ভালো। তবে কিছু বেসিক জিনিস মানতে হয়। যেমন আমাদের পেশায় ঘুম খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনও জায়গায় যে কোনও সময়ে ঘুমিয়ে পড়তে জানতে হবে। এছাড়া বেশি করে জল খাওয়া, সুস্থ সম্পর্কে থাকা এবং সুস্থভাবে থাকা দরকার। মন ভালো রাখা দরকার। আমাদের আশপাশে প্রতিনিয়ত যা ঘটছে, তাতে মন ভালো রাখা খুব কঠিন। তবে ইতিবাচক থাকতেই হবে।
শীত পড়ছে। আসছে বিয়েবাড়ি আর উৎসবের মরশুম। যুবকদের জন্য সাজগোজের টিপস?
নিজেকে যেটায় ভালো লাগবে এবং যেটায় আপনি কমফর্টেবল, সেটাই পরুন। কেউ এমন জামা পরলেন যে বিয়েবাড়িতে গিয়ে আর খেতেই পারলেন না! পুরো মজা মাটি। বা এমন সাজলেন যে সে সাজ সামলাতে সামলাতে সময় চলে গেল, বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আড্ডাই দেওয়া হল না। সেটা করবেন না। নিজেকে নিজের মতো করে সাজিয়ে তোলা, সুন্দর দেখতে চাওয়ার মধ্যে কোনও অপরাধ নেই। প্রত্যেকেই সেটা করুন। আত্মকেন্দ্রিক হবেন না কিন্তু নিজেকে ভালোবাসবেন। এখনকার প্রজন্ম তো বেশ সচেতন। কোথায় কীভাবে কী পরতে হবে, তারা ভালো জানে।
সদ্য জন্মদিন পেরোলেন। বিবাহবার্ষিকীও! এই দিনগুলো পরিণত বয়সে এসে কোনও বিশেষ উপলব্ধি তৈরি করে?
উপলব্ধি অবশ্যই তৈরি হয়। ওই দিনগুলোর গুরুত্বও আছে। অনেক মানুষের শুভেচ্ছা-ভালোবাসা পাই। মন ভালো হয়ে যায়। সঙ্গে দায়িত্বও বাড়ে। কারণ কাজের জন্যই মানুষ এত ভালোবাসা দিচ্ছেন। এছাড়া আমি ব্যক্তিগতভাবে কম্প্যানিয়নশিপ-এ বিশ্বাস করি। বিবাহবার্ষিকীতেও সেটা ভীষণভাবে সত্যি। জীবনে যাই ঘটুক ভালো বা মন্দ, সবটাই যেন একসঙ্গে ফেস করতে পারি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা সকলেই পরিণত হই। আমার মনে হয় আমি আরও সিলেকটিভ হয়েছি। তা সে কাজ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে হোক বা বন্ধু নির্বাচন।