চারুপমা

রুপোং দেহি

ইদানীং বাঙালি কন্যেদের মন মজেছে রুপোর গয়নায়। পুজোর সাজে সঙ্গী করে নিন শুভ্র ধাতুকে। লিখেছেন অন্বেষা দত্ত।

পুরনো  কথা
রূপকথার গল্পে রানির ছিল সোনার খাটে গা আর রুপোর খাটে পা। আহা, রুপো যেন বরাবরের দুয়োরানি। কিন্তু রুপোর কদর জানত ফেলে আসা অতীত। হাল আমলে রৌপ্যমোদী কন্যেদের ঝোঁক বোঝার আগে বরং ফিরে যাওয়া যাক সে যুগে, যখন ধাতু হিসেবে রুপোর যথেষ্ট নামডাক ছিল।
   সময়টা হবে খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছরের আশপাশে। রুপোর তথাকথিত ‘আবিষ্কার’ এই কালেই। ধাতু হিসেবে তাকে কাজে লাগানো হল বাসনকোসন বানাতে। মূর্তি বানাতেও ব্যবহার হতো রুপো। শাসক শ্রেণি তথা ধনীদের আভিজাত্য-আনুকূল্যে গয়না রূপে রুপোর জৌলুস আরও বাড়ে। প্রাচীন মিশরে রুপোর গয়না তৈরি হতো রাজারানি আর ফারাওদের জন্য। প্রাচীন গ্রিসের দিকে তাকালেও রুপোর ইতিহাস একইরকম, সেখানেও ধনবান উচ্চবিত্তর ঘরেই কদর ছিল রুপোর গয়নার। মুদ্রার রূপ পাওয়ার পরে সমাজের বাকি অংশে একটু আধটু ছড়িয়েছে এ ধাতু। এ রাজা-সে রাজার রাজত্ব পেরিয়ে কয়েক শতক ধনীর ঘরের অলঙ্কার হয়েই দিন কাটাল শুভ্র ধাতুটি। শিল্পবিপ্লবের পরে অর্থনীতিতে এল আমূল পরিবর্তন। কলকারখানা বাড়ল। ভিক্টোরীয় যুগের মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে এল অর্থ। রুপোর চাহিদা বাড়ল। তবে খাঁটি রুপো (কারণ ৯৯ শতাংশ রুপো আরও সূক্ষ্ম এবং দামি) থেকে সরে এসে গণহারে যে রুপো তৈরি হল, তাতে মিশল তামা। রুপোর ভাগ রইল ৯২.৫ শতাংশ (যা এখনও চলছে)। ভিক্টোরীয় যুগে যেসব রুপোর গয়না দেখি, তার বেশিরভাগেরই সঙ্গে লাগানো থাকত মূল্যবান পাথর, রত্ন কিংবা মুক্তো। বিশ শতকে পৌঁছে শুরু হল নতুন ট্রেন্ড। মূলত এই সময় থেকেই রুপোর দিন গিয়াছে। সোনা আর প্ল্যাটিনামের দাপট ও দ্যুতিতে কোণঠাসা হতে শুরু করে রুপো।   
ভারতে রুপোর গয়নার প্রথম হদিশ দিল হরপ্পা সভ্যতা (খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০-১৮০০)। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর প্রাচীন প্রত্নস্থল খননে রুপোর তৈরি সামগ্রীই তার প্রমাণ দেয়। খ্রিস্টপূর্ব ছ’শতকে বুড়ো আঙুলের ছাপের মাপে রুপোর মুদ্রা তৈরি হল। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরিতেও ক্রমে ক্রমে ব্যবহার শুরু হল রুপোর। তক্ষশীলায় প্রত্নখনন তার প্রমাণ দেয়, সেই সময়টা মোটামুটি খ্রিস্ট যুগের প্রথম শতক। 
ভারতীয় সংস্কৃতিতে সোনার আদর বেশি থাকলেও রুপো একেবারে দুচ্ছাই ছিল না। হিন্দু রীতিতে সোনা পরতে হতো কোমরের উপরের অংশে। আর কোমরের নীচ থেকে পরা যেত রুপো। সোনাকে উচ্চস্থান দেওয়া হলেও রুপোর কদর ছিল। মনে করা হতো, কালাজাদুর প্রকোপ থেকে বাঁচাতে পারে রুপো। শ্বেত ধাতুটি ছিল চাঁদের সঙ্গে তুলনীয়। চুড়ি, আংটি, পায়ের তোড়াও তৈরি হতো। মাতৃত্বেরও প্রতীক ছিল এ ধাতু। মনে করা হতো, জীবন থেকে নেতিবাচক শক্তি দূর করতে রুপো ফলদায়ক।  

রাজ্যে  রাজ্যে
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রুপোর যাত্রাপথটা বেশ সুন্দর। রাজ্যভেদে বদলেছে তার রূপ ও ব্যবহার। কাশ্মীরে দেখা গিয়েছে, চায়ের পাত্র থেকে শুরু করে জলের জগ, বা পরিবেশনের ট্রে— সব কাজের জিনিস তৈরি হতো রুপোয়। তাতে থাকত কলকা, চিনার পাতা, লতাপাতা ফুল ইত্যাদির চিত্রবিচিত্র বক্ররেখা (অ্যারাবেস্ক) দেওয়া মোটিফ। অনেক সময় আবার রুপোর জিনিসে থাকত সোনার আবরণ, তাকে বলা হতো গঙ্গা-যমুনা স্টাইল। লাগোয়া পাঞ্জাবে কাশ্মীরের মতোই প্রভাব ছিল রুপোর জিনিসে। কাশ্মীরের প্রচুর শ্রমিক ১৯ শতকে পাঞ্জাবে রুজির খোঁজে যান। তাতেই কাজের ধরনে মিল তৈরি হয়। উত্তরপ্রদেশের লখনউয়েও কাশ্মীরি ছাপ ছিল যথেষ্ট। রাজস্থানে রৌপ্যনির্মিত প্লেট কদর পেত রাজপরিবারগুলোতে। এ রাজ্যের শিল্পীদের হাতের গুণে রুপো থেকে তৈরি হতো নানা মূর্তি, মদিরা পাত্র, হুঁকা, পানের বাক্স, আতরদান। ওড়িশায় রুপোর আর এক রূপ— মনোমুগ্ধকর ফিলিগ্রি। এখনও দারুণ জনপ্রিয় ফিলিগ্রি নকশা। সূক্ষ্ম এই নকশা থেকে গয়নার পাশাপাশি তৈরি হয় নানা শো পিসও। জালের মতো নকশার এই কাজ বহু প্রাচীন। মেসোপটেমিয়া ও মিশরীয় সংস্কৃতিতে প্রথম খোঁজ মেলে ফিলিগ্রি নকশার যা রোমান সভ্যতাতেও জনপ্রিয় ছিল। সোনা কিংবা রুপোর তার মিলিয়ে লেস-এর মতো সূক্ষ্ম একটা কিছু সৃষ্টি করা হতো। অন্ধ্রপ্রদেশের করিমনগর আর আমাদের রাজ্যের মুর্শিদাবাদেও এই কাজ হয়। দক্ষিণের কেরলেও রুপো থেকে গয়না এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তৈরি হতো। উৎস ছিল ছোট ছোট রুপোর কয়েন। এগুলোকে রুপোরই তারে একটানে বেঁধে অথবা কিছু কিছু মুদ্রার মধ্যে ফাঁক রেখে দিয়ে হতো জাফরির মতো নকশা। মহারাষ্ট্রের পুনে আর গুজরাতের কচ্ছেও রুপোর গয়না, বাসন এবং ঠাকুরদেবতার সুন্দর সুন্দর মূর্তি হতো।  

ফিরে এল কেন
রুপোয় হঠাৎ আবার সে এসেছে ফিরিয়া-র মরশুম কবে থেকে হল? কথা হচ্ছিল কলকাতা শহরের রুপোর কারবারিদের সঙ্গে। করিশ্মা’জ এই শহরে রুপো নিয়ে বহু দিন ব্যবসা চালাচ্ছে। বিপণির তরফে করিশ্মা-কন্যা তনিশা বললেন, ‘অনেকগুলো ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে বিক্রি বেড়েছে। গত দশ বছর ধরে ধারাটা বদলেছে। এখন আমাদের দেশে লোকে রুপোর কদর করছেন। আগে যেটা শুধুই সোনার জন্য তোলা থাকত। এখন মানুষ বুঝছেন সোনার মতো রুপোও মূল্যবান ধাতু। আর বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রেও ভালো বিকল্প। কারণ সবার তো সোনা কেনার সাধ্য থাকে না। কোভিডের পরে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়েছে। এখন সোনার একটা ছোট কিছু কিনতে গেলে যা দাম লাগে তাতে রুপোর একটা ভারী বড় সেট হয়ে যাবে। তার রিসেল ভ্যালুও রয়েছে। তাই চিন্তা বদলেছে।’ এছাড়া তনিশার মতে, অন্য যেসব ধাতুর গয়না পরার চল আছে, সেগুলো সবসময় রিসেল ভ্যালু পাওয়া এবং ভেঙে গেলে সারাই করা মুশকিল। কিন্তু রুপোর ক্ষেত্রে সারাইতে সমস্যা নেই, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ব্যবহারও করতে পারে। তাই ভরসা বাড়ছে। 
উপহার দেওয়ার জন্য এখন রুপো বেশ নির্ভরযোগ্য। সোনার আকাশছোঁয়া দামে উপহার দিতে মধ্যবিত্তের ঘুম ছোটে। টাকা খরচ করবেন অথচ জিনিসটা চোখে পড়ার মতোই হল না, সেটা কি ভালো লাগে? তনিশা বলছেন, ‘তাই উপহারেও এখন রুপো জনপ্রিয়।’
খাঁটি রুপো দিনে দিনে কালো হয়। আমাদের বাতাসে থাকা আর্দ্রতা এর জন্য দায়ী। সেই রুপোর জেল্লা ফেরাতে ব্যবহার করতে পারেন সাধারণ টুথ পাউডার। তবে বাঙালিরা আবার রুপো যত কালো হয়, যত অক্সিডাইজড লুকটা আসে, তত তা বেশি পছন্দ করেন, বিক্রির অভিজ্ঞতা থেকে বললেন তনিশা। অবশ্য রুপো নিয়মিত ব্যবহারে থাকলে বেশি কালোভাব হয় না, বরং উজ্জ্বল থাকে। 
রুপোর কথা বলতে গিয়ে ব্যতিক্রমী জুয়েলারি ব্র্যান্ড আর্থামেন্টের তরফে মোনালিসা মান্না মনে করালেন অতীতের কথা। তাঁর মতে, উত্তরপ্রদেশ, ছত্তিশগড় বা রাজস্থানের মতো বড় রাজ্যে জায়গায় রুপো তৈরি হতো বহুদিন। উপজাতিভুক্ত মানুষ রুপোর গয়না বরাবরই পছন্দ করেছেন। সোনা ছিল অভিজাতদের সম্পদ, দাম্ভিকতার পরিচয়। তবে সচেতন মানুষ কিন্তু রুপোর মাধ্যমে নিজের স্টাইল স্টেটমেন্ট তৈরি করতে দ্বিধাবোধ করেনি। মোনালিসা বললেন, ‘গত ১০-১৫ বছরে রুপোর কদর বেড়েছে কারণ সমাজের অগ্রণী শ্রেণি এতে গুরুত্ব দিয়েছে। অন্যরকম সাজ বা লুক তৈরি করাটাও প্রাধান্য পেয়েছে। সোনার দাম গত কুড়ি বছরে এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে মহিলারা অন্য ধাতুর গয়না পরার কথা ভেবেছেন— যেটা দেখতে খেলো নয়, অথচ ঐতিহ্যের অনুগামী। ভারতীয় উপজাতিদের মধ্যে যে ধাতুর বহুল ব্যবহার ছিল, সেটা তো ঐতিহ্যেরই অংশ। তাই এখন ভিন্টেজ লুকের বা ট্রাইবাল গয়না এত জনপ্রিয়।’ সাদা ধাতু বা পাথরে ঝোঁকটা বেশি পাশ্চাত্যে ছিল। ভারতীয়রা বরাবরই হলুদ ধাতুর পক্ষে। বিশ্বায়নে পাশ্চাত্যের গয়নার ছাপ এখানে পড়ে। স্থানীয় ধারাটাও রয়ে যায়। এতে ফিউশন তৈরি হয়, জানালেন মোনালিসা। পুরনো গয়নার নকশা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বর্তমান সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে রুপোর গয়না তৈরি করে আর্থামেন্টস। তাঁর কথায়, ‘আর্থামেন্টস হোক বা অন্য যারাই এখন রুপো নিয়ে কাজ করছে, তারা এই বিষয়টা মাথায় রাখছে। ডিজাইনের ক্ষেত্রে একটা মিশ্র জায়গায় রয়েছি আমরা। সাধারণ মানুষ সহজে কিনতে পারেন বলে এই ধাতু নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা অনেকটাই করা যাচ্ছে। আরও হবে ভবিষ্যতে।’ মোনালিসাও মানলেন উপহার হিসেবে রুপোর গয়নার গুরুত্ব বেড়েছে। ‘শুভ অনুষ্ঠানে গয়না দেওয়ার চল ছিল। এখন সোনার দাম বে‌ড়েছে যেমন রুপোরও বেড়েছে। তবু মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যে রয়েছে এই ধাতু। ভবিষ্যতে রুপোর দাম আরও বাড়বে বলেই অনুমান। এছাড়া, ভারতীয়দের ত্বকের রঙের সঙ্গে রুপো ভালো খাপ খায়। ফলে সব দিক থেকেই রুপোর রূপ মুগ্ধ করার মতো,’ বলেন তিনি। আর্থামেন্টস-এ মূলত রুপোর হোয়াইট ফিনিশ নিয়ে কাজ হয়। মোনালিসা জানালেন, ভিন্টেজ অক্সিডাইজড লুকটা পরিচিত। কিন্তু রুপোর প্রকৃত রং, আবহাওয়ার কারণে না পাল্টে গেলে যে ঝকঝকে সাদা ভাবটা থাকে, সেইটাই তাঁর ব্র্যান্ডের স্টেটমেন্ট। সাদা রুপো দিয়ে খুব সুন্দর সাজিয়ে তোলা যায় নিজেকে।জাঙ্ক তো অনেক হল, এবার পুজোয় রুপো দিয়ে স্টাইল কোশেন্ট কতটা বাড়ানো যায়, ভেবে দেখতে পারেন!
14Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় বা অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে অর্থাগমের উত্তম যোগ। ভুল পরিকল্পনায় কাজকর্মে বাধা আসতে পারে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.৬১ টাকা৮৪.৭০ টাকা
পাউন্ড১০৭.৫২ টাকা১১০.৪৫ টাকা
ইউরো৮৯.৯৯ টাকা৯২.৬৯ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
1st     November,   2024
দিন পঞ্জিকা