রূপটানে ফলের ব্যবহার নতুন নয়। ফলের রাজা আমও পিছিয়ে নেই তাতে। রূপবিশেষজ্ঞ কেয়া শেঠ-এর পরামর্শ নিয়ে লিখলেন স্বরলিপি ভট্টাচার্য।
ঝড়ের দিনে আম কুড়ানো, সঙ্গী দিদি। হইচই, চড়ুইভাতি, শরতে কাশবনের মাঠ পেরিয়ে রেলগাড়ি দেখা— বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘আম আঁটির ভেঁপু’-তে এভাবেই তো চিনিয়েছেন বাঙালির বড় আপন অপু-দুর্গাকে। আমের মুকুলের গন্ধে ছোটবেলা কুমিরডাঙা খেলার ডাক পাঠায় আজও। পুরনো পাঠক নতুন করে খুঁজে নেয় হারিয়ে যাওয়া বসতবাড়ি। আর নতুন পাঠক অপু-দুর্গার মধ্যে খুঁজতে থাকে নিজস্ব পরিসর। ছায়া সুনিবিড় আমবাগান আসলে ছাপার অক্ষরের বাইরেও চরিত্র হয়ে ওঠে নানা অনুসঙ্গে। আসলে ফলের রাজা আম এই পাঠ্যের প্রধান কুশীলব। গ্রীষ্মকাল প্রিয় বললেই বন্ধুমহলে ঠাট্টা জোটে অনেকের। কিন্তু সত্যিই এই ঋতুতে প্রাণের আরাম আমের কদর করেন না, এমন মানুষ সংখ্যায় কম। খেয়ে সুখ। খাইয়ে তৃপ্তি। এমন ফল আপনার সাজসঙ্গীও হতে পারে। শুধু প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতে জানতে হবে। সেই রূপরুটিনের হদিশ দিলেন রূপবিশেষজ্ঞ কেয়া শেঠ।
বন্ধু মুকুল
‘আম গাছের সব কিছু কাজে লাগে। কাঁচা আম থেকে পাকা আম, মুকুল থেকে আমের কচি পাতা, আমের পুরনো পাতা। আম গাছের ছালও কাজে লাগে,’ আলোচনার শুরুতেই বললেন কেয়া। শহর কলকাতায় কিছু বাড়িতে এখনও আমগাছের দেখা মেলে। তার মধ্যে বহু গাছেই মুকুল এবং আমের সহাবস্থান মে মাসের শেষেও অবাক করছে। আমের মুকুল দিয়েই শুরু করুন আপনার পরীক্ষানিরীক্ষা। কেয়া জানালেন, র্যাশ, ফুসকুড়ির জন্য আমের মুকুল ভীষণ ভালো। গরমে ঘামের থেকে র্যাশ, ফুসকুড়ির সমস্যা হয় অনেকের। তা ত্বকে অস্বস্তি বাড়ায়। আমের মুকুল জলে ফুটিয়ে যদি সেই জলে স্নান করা যায় বা জলটা সেই নির্দিষ্ট জায়গায় লাগানো যায়, তাহলে গরমের র্যাশ তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যায়।
কাঁচা আমের কেরামতি
কাঁচা আমের চাটনির চাহিদা এখন দুপুরে খাবার পাতে অনস্বীচার্য। সেই কাঁচা আম সেদ্ধ করে মিক্সিতে পেস্ট করে নিন। এর সঙ্গে অল্প একটু কেওলিন পাউডার মিশিয়ে প্যাক বানিয়ে নিন বাড়িতেই। গরমে ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। ত্বক নিজস্ব উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলে। এসব ত্বকের জন্য কাঁচা আমের এই প্যাক বন্ধু হতে পারে।
আঁটি কাহিনি
জগতে কোনও কিছুই আসলে ফেলে দেওয়ার নয়। সেই আপ্তবাক্য মনে রেখে কেয়া বললেন, ‘আমের আঁটি আমরা ফেলে দিই। আঁটির ভিতর একটা বীজ থাকে। সেই বীজটা থেঁতো করে ত্বকের যেখানে কালো স্পট, পিগমেনটেশন, ফ্রেকেলস রয়েছে, সেখানে লাগাতে পারেন। এটা খুব তাড়াতাড়ি দাগ নির্মূল করে। বীজের ভিতরের শিরে প্রচুর পরিমাণে ময়েশ্চার আছে। এই শির থেকে ম্যাঙ্গো বাটার তৈরি হয়। ত্বকের জন্য যতরকম বাটার ব্যবহার হয় ম্যাঙ্গো বাটার তার মধ্যে সবথেকে ভালো। বাড়িতে তো ইচ্ছে করলেই সবসময় ম্যাঙ্গো বাটার তৈরি করা যায় না। আপনারা বরং এভাবে ব্যবহার করতে পারেন।’
পাকা আম
নিত্যদিন রোদ্দুরে বেরিয়ে ত্বকে ট্যান পড়া কোনও নতুন সমস্যা নয়। কিন্তু এর মোকাবিলা করতে করতে ক্লান্ত সকলে। এবার পাকা আম ট্রাই করতে পারেন। কেয়া জানালেন, আম একটি রসাল ফল। পাকা আমে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন থাকে। যে কোনও সময় আম খেতে খেতে আমের রস মুখে লাগিয়ে নিতে পারেন। এতে ট্যান রিমুভ হবে। ত্বক ময়েশ্চারাইজড হবে। গরমে ত্বকে শুকনোভাব চলে আসে। সেটার জন্যও ভালো আমের রস। সপ্তাহে যে কোনও একদিন পাকা আমের কাথ নিয়ে তার সঙ্গে অল্প একটু মসুর ডাল বেটে একটা প্যাক তৈরি করে সারা শরীরে লাগিয়ে নিন। এতে একইসঙ্গে স্ক্রাবিং হবে এবং ত্বকের ট্যান উঠে যাবে। এমনকী ব্লিচের বদলে আম ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে কেয়া বললেন, ‘রোদ্দুর থেকে ফিরে, সমুদ্রের ধার থেকে ফিরে যারা ব্লিচ করে তাদের আমের রস লাগানোর পরামর্শ দেব। ব্লিচের প্রয়োজন হবে না। ত্বকের ট্যান উঠে যাবে, ফ্রেশ ফিল হবে।’
চুলের জাদুকর
শুধু ত্বক নয়। আম চুলের জন্যও ভালো। কেয়ার পরামর্শ, চুলের জন্য তৈরি যে কোনও প্যাকের সঙ্গে আম রাখতে পারেন। ধরা যাক, কোনও একটা ফ্রুট প্যাক তৈরি হচ্ছে। তার অর্ধেক আম নিতেই পারেন। আমের রস চুলে ভালো কন্ডিশনারের কাজও করে। চুল শুষ্ক হয়ে ভেঙে গেলে বা রং করে চুল করে খারাপ হয়ে গেলে পাকা আম এবং দই মিশিয়ে সপ্তাহে একদিন বা দশ দিনে একদিন লাগালে খুব তাড়াতাড়ি চুল স্বাস্থ্য ফিরে পাবে। চুলের উজ্জ্বলতাও ফিরে আসবে।
আম দুধ
পা ফাটার সমস্যা থাকলে আম ম্যাজিক করতে পারে। কেয়ার কথায়, ‘আম বা আমের পাতা ভাঙলে একটা সাদা আঠালো দুধ বেরোয়। যাদের সারা বছর পা ফাটার সমস্যা রয়েছে, তারা পা পরিষ্কার করে যদি আমের দুধ লাগান তাহলে খুব তাড়াতাড়ি পা ফাটা সেরে যায়।’
গাছের ছাল
স্ক্রাবার হিসেবেও আম ব্যবহার করতে পারেন। আম গাছের ছাল ভালো করে গুঁড়ো করে স্ক্রাবিংয়ের কাজে লাগানো যায়। কেয়া জানালেন, পাকা আমের সঙ্গে মিশিয়েও এই গুঁড়ো লাগাতে পারেন অথবা দইয়ের সঙ্গে মিশিয়েও কাজে লাগাতে পারেন। ‘যখন আমপাতা প্রথম বেরয় তখন একটু লালচে হয়ে থাকে। সেই পাতা জলে ফুটিয়ে যদি ভাপটা নেওয়া যায় তাহলে ব্রণর প্রবণতা কমে যাবে’, বললেন তিনি।
মনে রাখবেন
• আমের মধ্যে ভিটামিন এ আর সি ভরপুর রয়েছে। ভিটামিন এ ত্বকের বলিরেখা কমাতে সাহায্য করে। ভিটামিন সি কোলাজেন বৃদ্ধির সহায়ক।
• শুষ্ক, তৈলাক্ত, সাধারণ, স্পর্শকাতর সব ধরনের ত্বকে আম লাগানো যায়। স্পর্শকাতর ত্বকে কিছু না লাগালেও আমের রস লাগাতে পারেন।
• বাচ্চাদের ক্ষেত্রে শুধু পাকা আম কাজে লাগাতে হবে। আমগাছের অন্য কোনও অংশ কাজে লাগানো যাবে না।
• আমের রস চোখের তলার ডার্ক সার্কল কমাতে সাহায্য করে। ত্বকের যে কোনও অংশের কালো দাগছোপ দূর করে। ত্বক উজ্জ্বল করে।
• আমে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট থাকে। আমের শাঁস ত্বককে মোলায়েম করে। ময়েশ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে।
শুধু খেতে সুস্বাদু তাই নয়, ফলের রাজা আমকে এবার ত্বক ও চুলের বন্ধু করেও তুলতে পারেন।