ভোটের মরশুম শুরুর আগে ‘মডেল রিসোর্স’ সংস্থা কলকাতায় একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। পুরোদস্তুর রাজনৈতিক ইস্যু। প্রশ্নের মুখে রাখা হয়েছিল সব বয়সের এবং সবরকম শিক্ষাগত যোগ্যতার মানুষকে। নানাবিধ জিজ্ঞাস্য। কিন্তু তার মধ্যে মোক্ষম একটি প্রশ্ন ছিল, ‘আপনার মতে রামমন্দিরের জন্য ৬০০ কোটি টাকা খরচ করাটা কি যুক্তিসঙ্গত? নাকি এই টাকা গরিব মানুষের উন্নয়নের কাজে ব্যবহার হলে বেশি উপকার হতো?’ সবার উত্তরপত্র জোড়া দেওয়ার পর দেখা গেল, ৫৪ শতাংশ মানুষ রামমন্দিরের বিপক্ষে মত দিয়েছেন। তাঁদের মনে হয়, রামমন্দিরের বদলে দেশের উন্নয়নে ওই ৬০০ কোটি টাকা খরচ করা উচিত ছিল সরকারের। অর্থাৎ ইঙ্গিতটা স্পষ্ট—এই নমুনা সমীক্ষাকে যদি ভোটের মুখবন্ধ ধরা যায়, রামমন্দির হাওয়া কিন্তু নেই। একটা সময় মনে করা হয়েছিল, রামমন্দির উদ্বোধন বিরাট ডিভিডেন্ড দেবে নরেন্দ্র মোদিকে। অযোধ্যায় রামলালা ঘর পেলে তার আবেগেই লোকসভা নির্বাচনে জেটপ্লেনের গতিতে উড়ে যাবে বিজেপি। ভোট যত কাছে এসেছে, ফিকে হয়েছে এই তত্ত্ব। সবচেয়ে বড় কথা, গেরুয়া শিবিরও বুঝেছে... শুধু রামমন্দির সামনে রেখে ভোটে জেতা যাবে না। সমীক্ষা কি তারাও করেনি। আলবাৎ করেছে। মডেল রিসোর্সের মতো সংস্থা তাদের রিপোর্ট সামনে এনেছে। বিজেপি আনেনি। তারা তলে তলে ‘প্ল্যান বি’তে সরে গিয়েছে। কী সেই প্ল্যান? নতুন কিছু? একেবারে আউট অব দ্য বক্স? উঁহু, বিজেপির কৌশলের মজাটা হল, তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় একেবারে বিশ্বাসী নয়। তৈরি ছাঁচের উপর ভর করেই মোদি-ব্রিগেডের যাবতীয় প্ল্যান-পরিকল্পনা। এক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। রামমন্দির থেকে খানিক সরে এসে চিরাচরিত মেরুকরণেই মন দিয়েছে তারা। প্রত্যেক লোকসভা কেন্দ্র ধরে ভোটারের হিসেব কষা হয়েছে। আর যে যে আসনে উপায় রয়েছে, সেখানে মন দেওয়া হয়েছে সরাসরি হিন্দু ভোট একমুখী করার দিকে।
বালুরঘাট ঠিক এমনই একটা কেন্দ্র। আগামী শুক্রবার এখানে ভোট। বিজেপির প্রার্থী সুকান্ত মজুমদার। অধ্যাপক মানুষ। স্বচ্ছ ইমেজ। তারপরও তিনি চিন্তায় আছেন। কেন? তৃণমূল প্রার্থী বিপ্লব মিত্র কি এতটাই হেভিওয়েট? তা কিন্তু নয়। উল্টে দলের মধ্যে প্রথম দিকে তাঁকে নিয়ে খানিক অসন্তোষই ছিল। জেলায় তাঁর প্রভাব বাড়তেই তিনি পুরনোদের ছেঁটে ফেলেছিলেন। এই কেন্দ্রে অর্পিতা ঘোষের অনুগামী এখনও অনেকে আছেন। তাঁরাই বেশি করে চাপে পড়েছিলেন। ফল? ভোটের মুখে তৃণমূলেরই একটা বড় অংশ তাঁর বিরোধী হয়ে গিয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শুধরেছে। সব পক্ষই এখন প্রায় আসরে নেমেছে বিপ্লববাবুর হয়ে। কিন্তু পদের দিক থেকে বিচার করলে এরপরও সুকান্তবাবুর ওজন অনেকটা বেশি। কারণ তিনি বিজেপির রাজ্য সভাপতি। তার উপর অমিত শাহ ঘনিষ্ঠ। বহু মানুষ তাঁকে ওই পদের ভারের জন্যই হয়তো ভোট দেবেন। তাহলে তাঁর চাপ কোথায়? মেরুকরণ এবং বিজেপির ডেডিকেটেড ভোটারদের বাদ দিলে, সাধারণ মানুষের জন্য সুকান্তবাবুর কাছে রেল ছাড়া দেওয়ার মতো কিছু নেই। তিনটি ট্রেন নিজের কেন্দ্রের মানুষের জন্য নিশ্চিত করতে পেরেছেন তিনি। বালুরঘাটকে রাজ্যের মূল রেল মানচিত্রের সঙ্গে জুড়েছেন। সেটুকুই তাঁর প্রচারের একমাত্র কনফিডেন্স। কিন্তু মানুষ যখন তাঁকে প্রশ্ন করছে, মাথার উপর ছাদ কেন হয়নি? কিংবা ১০০ দিনের কাজের টাকা বন্ধ কেন? দুর্নীতির সাফাই ছাড়া অন্য উত্তর দিতে পারছেন না তিনি। আসলে তিনিও জানেন, পাঁচজনের অনিয়মের জন্য লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষের টাকা আটকে রাখা যায় না। তাহলে উপায় কী? মেরুকরণ। সেটা তাঁর জন্য অনেকটাই করার চেষ্টা চালিয়েছে আরএসএস। সঙ্ঘ পরিবার এবারের ভোটে যে কয়েকটি বাছাই করা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থীদের জন্য ব্যাট ধরেছে, তার মধ্যে বালুরঘাট একটি। ফল? আপাতদৃষ্টিতে যা বোঝা যাচ্ছে, বালুরঘাট শহরে সেই প্রভাব আছে। সুকান্তবাবু আশা করছেন, এই বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তিনি লিড পাবেন। খুব এদিক-ওদিক না হলে হবেও হয়তো তাই। এছাড়া গঙ্গারামপুর ও তপন এলাকা তাঁকে কিছুটা এগিয়ে দিতে পারে। তপনের ক্ষেত্রে যেমন তাঁকে সেরকম কিছু করতে হয়নি। দণ্ডিকাণ্ডের জন্য আদিবাসীদের একটা অংশ তৃণমূলের উপর ক্ষুব্ধ। তার কিছুটা প্রভাব ভোটে পড়বে। তৃণমূল মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে ড্যামেজ কন্ট্রোলের। খানিকটা হয়েওছে। তারপরও এই বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের লিড নেওয়ার সম্ভাবনা কম। তাহলে বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রে বিপ্লব মিত্রের অ্যাডভান্টেজ কোথায়? ইটাহার। এই একটি বিধানসভা এলাকা যদি তৃণমূলকে ৮০ থেকে ৮৫ হাজারের লিড দেয়, সুকান্ত মজুমদারকে তাঁর রাজপাট হারাতে হবে। তার উপর সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক তৃণমূলের সঙ্গে থাকবে বলেই বিশ্বাস বিপ্লববাবুর। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ব্যবসায়ীরা কিন্তু এবার মোটামুটি তৃণমূলের দিকেই ঝুঁকে রয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি এলাকায় থাকলে অনেকাংশেই কাজ করতে সুবিধা হয়। তার উপর পরিষেবার দিক থেকেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রহণযোগ্যতার ধারকাছে কেউ নেই। তা সে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার হোক বা স্বাস্থ্যসাথী, ভোটে নিশ্চিত লাভ দেবে।
পাশের কেন্দ্র রায়গঞ্জে আবার বিজেপি কিছুটা পিছিয়েই শুরু করেছে। সিটিং এমপি থাকা সত্ত্বেও। তিনি আবার মোদি মন্ত্রিসভার রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তাহলে কেন দেবশ্রী চৌধুরীকে সরিয়ে দেওয়া হল? কেনই বা তাঁকে রায়গঞ্জ থেকে সোজা কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ফেলল বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। কারণ তাঁদের কাছেও খবর গিয়েছে, নিজের কেন্দ্রেই দেবশ্রী চৌধুরীর জনপ্রিয়তা তলানিতে। কেন্দ্রের মানুষের জন্য তিনি কী করেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর গুনতে বসলে এক-দুইয়ের উপর উঠতে পারছে না রায়গঞ্জ। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও। তার উপর প্রার্থী হিসেবে ভূমিপুত্রের দাবিও উঠেছিল। দেবশ্রী আসলে বালুরঘাটের। থাকেন কলকাতায়। ফলে ক্ষোভ মেরামতে নতুন প্রার্থী ছাড়া গতি ছিল না। টিকিট দেওয়া হল কাকে? কার্তিক পাল। তিনি আগে ছিলেন কংগ্রেসে। তারপর তৃণমূলে গিয়ে কালিয়াগঞ্জের চেয়ারম্যানও হয়েছেন। তারপর বিজেপিতে এসেই টিকিটের দাবিদার। কার্তিক পাল দলবদলু হয়েও প্রার্থীপদ চান। জেলা সম্পাদক হওয়া সত্ত্বেও ইলেকশন কমিটিতে ঠাঁই মেলে না এবং গোঁসা করেন। সে নিয়ে চাপা বিক্ষোভ দেখান। আবার দলের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও বজায় রাখেন। ফলে গেরুয়া শিবিরে তিনি যে খুব পছন্দের মানুষ, তেমনটা কেউ বুক ঠুকে বলতে পারবে না। উল্টোদিকে তৃণমূলের কৃষ্ণ কল্যাণী। বিজেপি থেকে তৃণমূলে এসেছেন। ব্যবসায়ী মানুষ। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা আছে। নাকটা একটু উপরের দিকে থাকে ঠিকই (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক ছাড়া অন্য কাউকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে চান না)। কিন্তু ভোটের স্বার্থে আপাতত সবটাই গলে জল হয়েছে। কৃষ্ণ কল্যাণীকে প্রার্থী করায় তৃণমূলের যে অংশটার মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল, তারাও এখন কোমর বেঁধে ঝাঁপিয়েছে। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাফ বুঝিয়ে দিয়েছেন, কৃষ্ণ কল্যাণীকে জেতাতে না পারলে কেউ বিধানসভায় টিকিট পাবেন না। ফলে রায়গঞ্জ কেন্দ্রে তৃণমূলের অবস্থা এখন বেশ ভালো। একটিই কাঁটা এই আসনে খিঁচ হয়ে রয়েছে, আর তা হল কংগ্রেস প্রার্থী আলি ইমরান রমজ। এলাকায় তিনি ভিক্টর নামে পরিচিত। ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে কংগ্রেসে এসে প্রার্থী হয়েছেন। আর পুরো সময়টা পড়ে আছেন ইসলামপুরে। এই মহকুমা সংখ্যালঘু প্রভাবিত। তিনি চাইছেন, সংখ্যালঘু ভোট যতটা সম্ভব চেঁচে তুলে নিতে। তাতে কিছুটা হলেও অবশ্য লোকসান তৃণমূলের। মেরুকরণের প্রভাব যে ভোটারদের মধ্যে আছে, প্রতিশ্রুতি বা গ্যারান্টি পূরণ না হলেও তাঁদের অধিকাংশ ভোট দেবেন বিজেপিকে। বাকি ভোটব্যাঙ্ক ভাগ হোক, তৃণমূল কিছুতেই সেটা চাইবে না। আর সেই কারণেই দিনরাত এক করে ফেলছেন কৃষ্ণ কল্যাণী-কানাইয়ালাল আগরওয়ালরা। তাঁদের আশা, রায়গঞ্জ এবার তাঁরা বের করে নিতে পারবেন।
আর থাকল দার্জিলিং। বিস্তর দড়ি টানাটানির পর এই কেন্দ্রে শেষমেশ টিকিট পেয়েছেন রাজু বিস্তা। একসময় মনে হচ্ছিল, হর্ষবর্ধন শ্রিংলাই দার্জিলিংয়ের প্রার্থী হবেন। শিক্ষিত, প্রাক্তন বিদেশ সচিব, আমেরিকায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন এবং সবচেয়ে বড় কথা, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এবং বিজেপির হর্তাকর্তাদের ঘনিষ্ঠ। তারপরও তিনি কেন টিকিট পেলেন না? রাজু বিস্তা প্রায় খুল্লামখুল্লা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, অবসরপ্রাপ্ত আমলাকে টিকিট দিলে যদি ফল খারাপ হয়, তিনি দায়িত্ব নেবেন না। অর্থাৎ, বিক্ষোভ স্পষ্ট। বিভিন্ন বৈঠকেও সরাসরি ক্ষোভ জানিয়ে রেখেছিলেন বিস্তা। বিজেপি নেতৃত্ব জানে, দার্জিলিং কেন্দ্রে বিস্তা বড় ফ্যাক্টর। বরং বলা ভালো, এক্স ফ্যাক্টর। তাঁর টাকা আছে, এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগও বেশ ভালো। কাকে দিয়ে কোন কাজ হবে, সেটাও তিনি জানেন। আর জানেন কোন ওষুধে কার ‘রোগ সারবে’। পাশাপাশি গোর্খাল্যান্ড ইস্যু তো আছেই। গত কয়েক বছরে এই ইস্যুটি অনেকটা ধামাচাপা পড়েছে ঠিকই, কিন্তু এখানকার প্রার্থী হতে গেলে গোর্খাল্যান্ড একেবারে বাদ দেওয়া যায় না। পাহাড়ের মানুষও বিশ্বাস করেন, কেন্দ্রে যে দল সরকার গড়বে, তাদের সঙ্গে থাকলে দাবিদাওয়া মেটার সম্ভাবনা প্রবল। পাশাপাশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে দার্জিলিংয়ের জন্য অনেকটাই করেছেন, সেটাও অস্বীকার করেন না তাঁরা। টাকা যেখানে আছে, দুর্নীতি সেখানে কিছুটা হলেও থাকবে—ভারতের রাজনীতির এটাই সারসত্য। সেই অভিযোগ জিটিএ’র ক্ষেত্রেও উড়িয়ে দেন না পাহাড়ের মানুষ। তাহলে কি তৃণমূল প্রার্থী গোপাল লামা এগিয়ে? তা নয়। বরং অ্যাডভান্টেজ রয়েছে রাজু বিস্তারই। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, গত কয়েক বছরের মতো একপেশে হবে না এবারের দার্জিলিং। তৃণমূল লড়াইয়ে থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে। তার প্রধান কারণ চা-বাগান। এখানে জমির পাট্টা বিলি, মজুরি, মাথার উপর ছাদ দেওয়ার মতো প্রকল্প মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা এবং তাঁর প্রতি পাহাড়ের মানুষের আস্থা অনেকটাই বাড়িয়েছে। চোপড়া থেকে তৃণমূল লিড পেয়েই থাকে। বাকি এলাকা যদি কিছুটা সমর্থন জোগায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দার্জিলিং থেকে একেবারে হারিয়ে যে যাবেন না, সেটা নিশ্চিত। আর তিনি জানেন, এখানে আর যাই হোক, রামমন্দির হাওয়া কাজ করবে না। সেটা অবশ্য শুধু দার্জিলিং নয়, রাজ্যের কোনও অংশে দোলা দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। তাই মোদি নিজেও শ্রীরামকে ছেড়ে গ্যারান্টি দিচ্ছেন। কীসের গ্যারান্টি? ভবিষ্যতে কাজ করার? ২০৪৭ অনেক দূর। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার কিন্তু বর্তমান। মানুষ যদি আজ ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েই সত্যিই ভাবে, ৬০০ কোটি টাকায় তাঁর সমাজের কী কী উন্নয়ন হতে পারত, ভোট কোন দিকে যাবে মোদিজি?
গ্যারান্টি নেই।