ঘটা করে ইস্তাহার বেরিয়েছে গত রবিবার। প্রধানমন্ত্রীও ইতিমধ্যেই দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ জনসভার সংখ্যায় হাফ সেঞ্চুরি পেরিয়ে ছুটছেন। কিন্তু বাংলার গরিব মানুষের বকেয়া একশো দিনের কাজের টাকা ছাড়ার প্রতিশ্রুতি দিতে কেউ শুনেছেন একবারও? কিংবা ডুমুরের ফুল হয়ে হারিয়ে যাওয়া সরকারি চাকরির রোডম্যাপ। আটকে রয়েছে আবাসের টাকা, জিএসটি’র ক্ষতিপূরণ, ন্যূনতম সহায়কমূল্য নিয়ে আইন প্রণয়ন। এখানেও না থেমে বিজেপির পক্ষ থেকে জিতে এলে তিনমাসের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বন্ধ করে দেওয়ার হমকি দেওয়া হয়েছে বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে। কোনও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন নেতা ‘খুলে আম’ একথা বলতে পারেন নির্বাচনী আবহে। এ তো বাংলার নারীশক্তির বিরুদ্ধে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ঘোষণার প্রস্তুতি। তাহলে কোন বিকশিত ভারতের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দল? ইস্তাহার জুড়ে মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্ব নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করা হয়নি। নেই মানুষের বাস্তব সঙ্কট সমাধানের সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি। আরও ২৩ বছর পেরিয়ে ২০৪৭ সালে স্বাধীনতার শতবর্ষের মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হবে। তখন যাঁরা বেঁচে থাকবেন তাঁরা লাস্ট ল্যাপ দৌড়ে এসে কী পাবেন? তার কোনও লেখাজোখা নেই চিত্রগুপ্তের ৭৬ পৃষ্ঠার খাতাতেও, মায় গালভরা ইস্তাহারে!
অথচ মানুষের কথা, সাধারণের আশা আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন ফেরি করেই চোদ্দো সালে মোদিজির ক্ষমতা দখল নিঃসন্দেহে ছিল ঐতিহাসিক ঘটনা। ‘বহুত হুয়ি মেহেঙ্গাই কা মার, অব কি বার মোদি সরকার’, এই স্লোগানে ভর করেই ক্ষমতায় এসেছিলেন। এক দশকের ইউপিএ শাসনকে হটিয়ে ক্ষমতা দখলই ছিল সেদিনের স্বপ্ন। এককভাবে ৩০০ নয়, ৪০০ নয়, আড়াইশোও নয়, এজেন্সি ছুটিয়ে বিরোধীদের গোড়া থেকে নিকেশও নয়, যেকোনও মূল্যে কংগ্রেস সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এনডিএ’র ছাতার তলায় থেকে ২৭২ আসনের গরিষ্ঠতা অর্জনই ছিল টার্গেট। এককভাবে বিজেপি নয়, এনডিএ’র আড়াল থেকেই লড়াই করেছিল প্রায় দু’ডজন শরিক। শিবসেনা, অকালি, তেলুগু দেশম, আপনা দল...। আজ তারা আলাদা আলাদা দ্বীপ। বিজেপির ইস্তাহারেও আজকের মতো শুধু একজনের ছবি আর তাঁর অতুল গৌরবগাথা নয়, শোভা পেয়েছিল পরপর ১১ জনের ছবি। বাজপেয়ি থেকে মুরলীমনোহর যোশি। রাজনাথ থেকে আদবানিজি। তখন রান্নার গ্যাসের দাম ছিল ৫০০ টাকার সামান্য বেশি। পেট্রলও আজকের মতো অগ্নিমূল্য ছিল না। তারপর অবশ্য গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। ২০১৯ সাল থেকেই দল, সরকার ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অভিমুখ একজনই। সম্মিলিতভাবে দল নয়, দলের আদর্শ ও দর্শন নয়, নীতিনিষ্ঠ নির্মম আরএসএসও নয়, আজ টানা তৃতীয়বার ক্ষমতা দখলের রেকর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে শুধুই একজন ব্যক্তি। গৌরবে বহুবচন হয় শুনেছি, কিন্তু ভারতীয় রাজনীতি এই মুহূর্তে ৫৬ ইঞ্চির আস্ফালনে প্রকৃত অর্থেই একবচনের ঘেরাটোপে অসহায়ভাবে বন্দি। তিনিই বুক ফুলিয়ে ৪০০ আসনের কথা বলছেন বারবার। এবং সেই ‘জুমলা’কে বাস্তবায়িত করতে হরেক কিসিমের বায়বীয় গ্যারান্টি ফেরি করে চলেছেন রাতদিন। এনডিএ অনেক দিনই ইতিহাসের গর্ভে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক এই নয়া বিজেপির দলগত উপস্থিতিও আজ ম্লান, ব্যাকফুটে নাগপুরও। পরতে পরতে স্লোগান বদলে কোথাও আর ‘আচ্ছে দিনে’র কথা নেই। নগদ ১৫ লাখ, বছরে দু’কোটি চাকরিও বিস্মৃতির অতলে। সাধারণের চাওয়া পাওয়ার হিসেব নেই। নেই মেহেঙ্গাই, বেরোজগারি দূর করার সংকল্প কিংবা অগ্নিগর্ভ মণিপুরের জন্য শান্তির ললিতবাণী। যুবসমাজকে সরকারি চাকরি দেওয়ার দিকনির্দেশ। দ্বিগুণ আয়ের কৃষক স্বপ্ন, বঞ্চিত শ্রমিক, পরিযায়ী, খেটে খাওয়া দিনমজুর সহ দেশের প্রান্তিক মানুষের অসহনীয় জীবনযাপনের বারোমাস্যাও অদ্ভুতভাবে অনুপস্থিত। সংকল্প পত্র নামক ৭৬ পৃষ্ঠার আনাচে-কানাচে শুধুই সরকার, থুড়ি ব্যক্তি সাফল্যের খতিয়ান আর গালভরা প্রতিশ্রুতির বন্যা। সঙ্গে দেশে বিদেশে এক ব্যক্তির দৃপ্ত পদচারণার হিসেব নিকেশ। চীন, রাশিয়া দুই বৃহৎ শক্তির সঙ্গেই দূরত্ব বাড়লেও বিদেশনীতির সাফল্যগাথায় কোথাও ছেদ নেই। ইস্তাহারে তাঁর ছবিই শোভা পাচ্ছে ৫০টার মতো। আর চতুর্দিকে ঘুরপাক খাওয়া এক অদৃশ্য হাওয়া যা ফিসফিস করে কানে কানে বলে চলেছে, এমনটা আগে কেউ করেনি, কেউ করতেও পারবে না! নেহরু থেকে ইন্দিরা, মোরারজি থেকে বাজপেয়ি, দেশের ৭৫ বছর পেরিয়ে গণতন্ত্রের জয়যাত্রার কাণ্ডারীরা সব ভ্যানিশ! শুধু একটা দমকা হাওয়াকে সুচতুরভাবে প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে দেওয়া। এর নামই কি আদর্শ অমৃতকাল!
প্রমিস, অ্যাকশন, ডেলিভারি। প্রতিশ্রুতি, পদক্ষেপ এবং কার্যক্ষেত্রে তার সুফল রূপায়ণ ও সুষ্ঠভাবে সাধারণ মানুষকে প্রদান। এদেশে এটাই সুষ্ঠুভাবে সরকার চালানোর চাবিকাঠি। শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেস দল, যাকে সকাল সন্ধে তোপ না দেগে অমিত শাহদের ভাত হজম হয় না, তার ইস্তাহারেও বেকার যুবকদের বছরে লাখ টাকার অ্যাপ্রেন্টিসশিপের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ৩০ লাখ সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। তৃণমূলও সীমিত ক্ষমতায় দেশজুড়ে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার চালুর শপথ নিয়েছে। মানুষের কল্যাণে দশদফা দিদির শপথের অঙ্গীকার করেছে। তাতে মাথার উপর পাকা ছাদ, দু’হাতে কাজের কথা যেমন বলা হয়েছে তেমনি সিএএ, এনআরসি করতে না দেওয়ার শপথ। অথচ বিজেপির ইস্তাহারে গরিবদের জন্য সংস্থান শূন্য। ৪৫ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বেকারত্ব। পেট্রল ডিজেল রান্নার গ্যাস ভোটের মুখে সামান্য কমলেও তা গোদের উপর বিষফোঁড়াই। সুরাহা তেমন মেলেনি। বরং গেরুয়া শক্তি আবার ক্ষমতায় এলে বিপুল উদ্যমে পেট্রপণ্যের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা চেপে বসছে। কারণ ইরান ও ইজরায়েলের যুদ্ধ নতুন করে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধিতে ইন্ধন জোগাচ্ছে।
কিন্তু যে দল সকাল বিকেল অলীক ৪০০ আসন জেতার স্বপ্ন দেখাচ্ছে তার ইস্তাহারে মানুষ কতটুকু, আর কতটুকুই বা সরকার, দল, দলের আদর্শ? নাকি সবছেড়ে একজন ব্যক্তি ও তার কৃতকর্মের চর্বিত চর্বন! স্বপ্ন ফানুসের ফেরি, জনগণের হাতে পেন্সিল। দশ বছর আগে মেহেঙ্গাই, বেকারত্ব, নিরপেক্ষ সুশাসন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অঙ্গীকার করে ক্ষমতা দখলের মুহূর্তে এজেন্সি হাতে ছিল না। সিবিআই, ইডি বশ মানা পোষ্যের মতো ওম গায়ে মেখে দরজায় লেজ নাড়ত না। তবু টু-জি, কয়লা ব্লক বণ্টন সহ একটার পর একটা স্ক্যাম নিয়ে দেশ উত্তাল করেছিলেন অমিত শাহরা। আর আজ স্বাধীনতা উত্তর ভারতের সর্ববৃহৎ নির্বাচনী বন্ড কেলেঙ্কারি নিয়ে বিরোধীরা বলতে উঠলেই তাদের মুখ বন্ধ করার শত আয়োজন। অথচ যে সংস্থা লোকসানে চলছে, ঘটিবাটি বিক্রি হওয়ার জোগাড় সেও কেন একটি বিশেষ দলকে কোটি কোটি টাকা চাঁদা দেবে কিংবা টাকা দিয়ে সরকারি বরাত হাসিল করবে, সেই রহস্যের কিনারা করতে কারও মন চায় না। শুধু মন ব্যাকুল বিরোধীদের পিছনে ইডি লাগিয়ে প্রতিবাদী মুখে সেলোটেপ লাগিয়ে দিতে। দু’-দুটো মুখ্যমন্ত্রী জেলে। চাকরির হদিশ নেই, অথচ দশ লক্ষ শূন্যপদ ফাঁকা বছরের পর বছর। ওদিকে নজর নেই। অথচ ইতিমধ্যেই জিতে এসে ১০০ দিনের রোড ম্যাপ তৈরির যে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে তাতে বিরোধীদের উপর এজেন্সির আঘাত যে আরও তীব্র আকার নেবে তা নিশ্চিত। কিন্তু তাতে কি ওষুধের দাম কমবে, পেট্রল সহজলভ্য হবে? বেকার ছেলেমেয়েরা নিজেদের অধিকারে চাকরি পাবে? প্রবীণ নাগরিকদের ব্যাঙ্কের সুদে, পেনশনে কোনও সুরাহা হবে?
পরিবারবাদকে খতম করাই যার একমাত্র লক্ষ্য বললেও অত্যুক্তি হবে না, তিনিই কখন ব্যক্তিসর্বস্ব এক খাঁচায় বন্দি হয়ে গিয়েছেন। তিনি শুধুই ক্ষমতায় আসার কথা বলেন, অথচ মানুষের দুর্দশা মোচনের ব্যাপারে আগ্রহ দেখান না। ৪০০ না হোক ২২৫ কিংবা তার কম পেয়েও যদি নানা ছলছুতোয় ক্ষমতায় আসেন সেক্ষেত্রে আদবানি-বাজপেয়ির বিজেপি অচিরেই ব্যক্তিতন্ত্রের পূজারি হয়ে উঠবে। এ ন্যারেটিভে কোথাও বিন্দুমাত্র খেদ নেই। ৪৪ বছর আগে তৈরি বিজেপি’র এটাই মর্মান্তিক পরিণতি। আর তা করতে গিয়েই সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে নয়া বিজেপি। পেটে ভাত না থাকলে আর হাতে কাজ বাড়ন্ত হলে চোখ ধাঁধানো হিন্দুরাষ্ট্র, চকমেলান হাজার কোটির মন্দির, সিএএ, এনআরসি, তিন তালাকের তাৎপর্য কী? অভিন্ন দেওয়ানি বিধি দিয়েই বা কী হবে? পেট ভরবে তো? সবই তো আসলে বিভাজনেরই তাস মাত্র। ধর্ম যদি দেশের একমাত্র চালিকাশক্তি হয় তাহলে তার পরিণাম ভালো হতে পারে না। স্বামী বিবেকানন্দও তাই বলেছিলেন, গীতাপাঠের চেয়ে শরীর চর্চা অনেক বেশি জরুরি। অনেক বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ফুটবল খেলায়।
এই নির্বাচনে জনতা কার গলায় বরমাল্য পরাবে আমরা জানি না। কোন দল কটা আসন পাবে তাও অনিশ্চিত। কিন্তু যে মহল ইতিমধ্যেই এদেশের সীমানা ছাড়িয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে সক্রিয় তা হচ্ছে, ‘মোদিজি কা আনা তয়ার হ্যায়’। দেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি এসব অলঙ্করণ মাত্র। এই নির্বাচন গরিবের নয়, বেকারের নয়, মূল্যবৃদ্ধিতে, প্যানডেমিকে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া দেশবাসীরও নয়, শুধু মোদিজি ফিরবেন কি ফিরবেন না। ফিরলে কোথায় থামবেন, সেই উত্তরের দিকে তাকিয়ে। যদি সব হিসেব উল্টে তাঁর প্রত্যাবর্তন থমকে যায়, সেক্ষেত্রে তা হবে স্বাধীনতার ৭৫ বছরে ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে বড় অঘটন। তখন ২০৪৭ সালের বিকশিত ভারতের স্বপ্নপূরণের জন্য অপেক্ষা করবে কে? ইতিহাসেরও আগে কখনও ছুটতে নেই, ইতিহাস রচনার কুশীলবকে...। সেক্ষেত্রে ইতিহাসের নীচেই হারিয়ে যাওয়াই অনিবার্য পরিণতি। বলবান সময়ই শেষ কথা বলে এসেছে আজ পর্যন্ত।
আর কে না জানে সর্বশক্তিমান হিটলারকেও কিন্তু বাধ্য হয়ে আত্মহত্যাই করতে হয়েছিল বাঙ্কারের মধ্যে। ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫। মাত্র ৭৯ বছর আগের কথা।