বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, হিউম্যারিস্ট স্টিফেন লিকক বলেছিলেন, প্রবাদগুলো নতুন করে লেখা উচিত। কারণ এগুলো প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। এমনকী, কিছু প্রবাদ সাম্প্রতিক বাস্তবের বিপরীত ব্যাখ্যাই বহন করছে। প্রবাদ: কাচের ঘরের বাসিন্দাদের কখনওই অন্যের দিকে ঢিল ছোড়া উচিত নয়। সেখানে স্টিফেন লিককের যুক্তি, বেঁচে থাকতে হলে কাচের ঘরের বাসিন্দারাই ঢিল ছুড়বে এবং অনবরত, যাতে অন্যদের একটা ঢিলও কাচের ঘর ঘেঁষতে না-পারে। প্রবাদটির বক্তব্য আমরা জানি—যাদের কিছু দোষ-ত্রুটি রয়েছে, তাদের অন্যের সমালোচনা করা উচিত নয়। কারণ পাল্টা সমালোচনা শুরু হলে তাদেরই কেচ্ছা বেরিয়ে পড়বে। লিককের তির্যক যুক্তি হল, যারা হাজার দোষে দুষ্ট তাদের ব্রত হওয়া উচিত—অন্যদের সমালোচনায় অনবরত মুখর থাকা, যাতে তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার অবকাশই কেউ না-পায়!
নোট বদল নিয়ে সংঘর্ষ
নোট বাতিল করা হয়েছিল ২০১৬ সালে। তারপর চালু করা হয় ২০০০ টাকার নোট। ওই মুদ্রা ছাপতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের খরচ হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা। এরপর এটিএমগুলিকে পিঙ্ক নোটের উপযুক্ত করে তুলতে ব্যাঙ্কগুলির উপর চাপে বিপুল ব্যয়ের বোঝা। শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিই ৩২ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে বাধ্য হয়। এবার সেই নোটও প্রত্যাহার (আসলে বাতিল) করা হল গত মে মাসে। হুকুম জারি হল, দু’হাজারি নোটগুলো নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে ব্যাঙ্ক থেকে বদলে নাও। বাড়ির কাছের ব্যাঙ্কের দরজা অবশ্য এজন্য বেশিদিন খোলা ছিল না। পরিবর্তে নাগরিকদের পাঠানো হল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাউন্টারে। এখন আরবিআইয়ের সামনে উদ্বিগ্ন মানুষজনের লম্বা লাইন। ক’জনের আর লাইনে দাঁড়ানোর সামর্থ্য, সময় ও ধৈর্য থাকে? এই মওকায় গজিয়ে উঠেছে দালাল চক্র। মানে কিছু কমিশন দাও, তোমারটা তাড়াতাড়ি করে দেব। এমন বন্দোবস্ত কখনওই শান্তিপূর্ণ হতে পারে না, এবং হচ্ছেও না। যেমন ২২ ফেব্রুয়ারি, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কলকাতায় আরবিআই অফিসের সামনে ছোটখাট সংঘর্ষ ঘটল। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জখম হলেন কয়েকজন। সাতবছর আগের বিষাদময় স্মৃতিই ফিরল। অথচ, এটা ছিল দেশ থেকে দুর্নীতির মূল উপড়ে ফেলার অঙ্গীকারের অংশ। সেই অঙ্গীকার পূরণ দূর, বাস্তবে দেখা গেল জালিয়াত এবং কালো টাকার কারবারিদের বাড়তি সুবিধাই করে দিয়েছে পিঙ্ক নোট। আর সেজন্যই শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে খারিজ হচ্ছে দু’হাজারি মনসবদারি। মাঝখান থেকে নিরপরাধ মানুষগুলোর ভয়াবহ দুর্ভোগ এবং আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিই সার!
সাইবার গ্যাংয়ের মওকা
সাইবার অপরাধীরা অনেকের চেয়ে বেশি ধুরন্ধর। উৎপাদন ও ব্যবসার একটা ফলপ্রসূ কৌশলের নাম ‘ডাইভার্সিফিকেশন’। ঠগবাজরা এতে আস্থা রাখে আরও বেশি। কারণ কোনও একটা ছক বহু মানুষের কাছে ফাঁস হয়ে যেতে বেশি দেরি হয় না। তাই তারা নিত্যনতুন কৌশল বের করে। যেমন ওটিপি এবং অন্যান্য তথ্য হাতিয়ে ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড প্রতারণা করা এখন কঠিন হয়ে গিয়েছে। ফলে প্রতারকরা মার্কেট ধরে রাখতে ইলেক্ট্রিক বিল পেমেন্ট না-হওয়ায় বিদ্যুৎ লাইন কাটার ভয় দেখানো, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ব্লক হয়ে যাওয়ার মতো কৌশল নেয়। মোটা টাকার লটারি কিংবা ব্যাঙ্ক কার্ডের ক্রেডিট পয়েন্টস রিডিম করার লোভও দেখায়। বিমার টাকা পাইয়ে দেওয়ার টোপ আসে এসএমএস/ইমেল মারফত। এসবই এখন পুরনো। সাইবার প্রতারকরা এবার আসরে হাজির আধার বাতিলের যন্ত্রণাকে হাতিয়ার করে। ইতিমধ্যেই, অসংখ্য গরিব মানুষকে আধার বাতিলের (নিষ্ক্রিয়) চিঠি ধরানো হয়েছে। তার ফলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেকের ব্যাঙ্কে লেনদেন। সংসার খরচ থেকে হাসপাতালের বিল মেটানো—কিছুই করা যাচ্ছে না। রেশনের খাদ্য নিতে গিয়েও খালি হাতে বাড়ি ফিরছেন অনেকে। বিপাকে পড়ুয়ারাও। তারা স্টাইপেন্ডের টাকা তুলতে পারছে না। কিছুদিন পরে বিভিন্ন এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসা এবং কলেজে ভর্তির কী হবে, তা ভেবে রাতের ঘুম ছুটেছে তাদের। বিপদ এখানেই শেষ নয়, নিষ্ক্রিয় আধার কার্ড ফের চালু করে দেওয়ার টোপ নিয়ে আসরে অবতীর্ণ ক্রিমিনালরাও। এই কাজের ফি’র জন্য তারা দাবি করছে গ্রাহকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের গোপন তথ্যাদি। কেন্দ্রীয় এজেন্সির দৌরাত্ম্যে ইতিমধ্যেই ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা মোদি-বিরোধীদের। তার সাতকাহন অবগত দেশবাসী। ইডি, সিবিআই জুজু এবার সাইবার শয়তানরাও লুফে নিয়েছে। এই দুর্বৃত্তদের নয়া শিকারের নাম রিটায়ার্ড পার্সনস—বিশেষত যাঁরা উচ্চপদে চাকরি শেষে মোট অঙ্কের অর্থ পেয়েছেন। একটি কেন্দ্রীয় এজেন্সির নাম করে ফোনে তাঁদের ভয় দেখানো হচ্ছে—আপনার নামে একাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে আপনারই অজান্তে এবং সেগুলি মারফত বিপুল কালো টাকার লেনদেন ঘটছে! সমাধানের পথ বাতলে দেওয়ার অছিলায় তারা টাকা দাবি করছে। কিছু ব্যক্তি এই ফাঁদে পা দিয়ে বহু টাকা খুইয়েছেনও। বঙ্গদেশে বর্গির হানা এমন হয়েছিল যে, দুষ্টু বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে তাদেরই ভয় দেখাতেন মায়েরা। মোদি সরকার এত ঘন ঘন দুর্ভোগের রকমারি ‘উপহার’ দিচ্ছে যে সাধারণ মানুষ তাল মেলাতেই পারছে না। তাল কেটে গিয়ে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গরিরগুর্বোদের সঙ্গে সুশিক্ষিত এবং প্রাক্তন পদাধিকারীরাও!
দুর্নীতির রাজনীতি
রেশন ব্যবস্থার পাশাপাশি মিড ডে মিলে দুর্নীতি হয়েছে বলে বিস্তর লাফালাফি করেছিল বঙ্গ বিজেপি। শিশুদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্বয়ং! তদন্তেও এগিয়েছিল ইডি-সিবিআই জুটি। কিন্তু বাস্তবে খারাপ তথ্যই মেলেনি। বরং সম্প্রতি কেন্দ্র-রাজ্য বৈঠকে বাংলা বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এমনকী, মিড ডে মিল (পিএম পোষণ) প্রকল্প নিয়ে বাংলার ব্যবস্থাটিকেই ‘মডেল’ করতে চেয়েছেন দিল্লির কর্তারা। ৫ মার্চ রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু দেশের সেরা পুরসভাগুলিকে পুরস্কৃত করবেন। সেই তালিকায় বিবেচিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গেরও ১১টি পুরসভা। পানীয় জল, নিকাশি প্রভৃতি নাগরিক পরিষেবার উন্নয়নে ‘অম্রুত’ প্রকল্প চালু করেছে কেন্দ্র। সেটি বিশেষ সাফল্যের সঙ্গে রূপায়ণে বাংলা যে দক্ষতা ও স্বচ্ছতার পরিচয় দিয়েছে, এরপর তা বুঝতে বাকি থাকে কি? তবু মনরেগা এবং আবাস নিয়ে গ্রামবাংলার লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষের সঙ্গে বঞ্চনার ইতিহাস গড়েছেন মোদিরা। রাজ্যের হিসেবে, ইতিমধ্যে বাংলায় জব কার্ডধারী ১২ হাজার গরিব মানুষ বঞ্চনা নিয়েই পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছেন। এই রাজ্যকে ২৬ মাস যাবৎ একশো দিনের কাজ ও টাকা দেয়নি দিল্লি। অথচ বিজেপি-শাসিত মধ্যপ্রদেশে আবাস যোজনায় ভূরি ভূরি অনিয়ম ঘটেছে। ক্যাগ সেসব ধরার পরেও ওই রাজ্যে কেন্দ্রীয় টাকার ফ্লো বন্ধ হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে সামান্যতম পদক্ষেপেরও খবর নেই। পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের টাকা পেতে অনলাইন অডিট বাধ্যতামূলক। সেই নিয়ম প্রশংসনীয়ভাবে মেনে চলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গ। অন্যদিকে, এই প্রশ্নে ডাহা ফেল বেশিরভাগ ‘ডাবল ইঞ্জিন’ রাজ্য। তবু ওই ‘আলালের ঘরের দুলাল’দের গায়ে আঁচড়টিও পড়ছে না! এখানেই পরিষ্কার নয় কি—মোদি সরকারের এত নিয়মের বেড়াজাল কতটা রাজনৈতিক মতলব আর কতটা প্রশাসনিক দায়?
পেটের সওয়াল
বছরে ২ কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি—মোদি জমানার দশক শেষের আগেই ‘জুমলা’ বলে প্রমাণিত। ইপিএফও’র হালফিল তথ্য বলছে, উল্টে নতুন চাকরির প্রবণতা নিম্নমুখী—২০২২ সালের তুলনায় গতবছর ১০ শতাংশ হ্রাস রেকর্ড হয়েছে। সম্প্রতি ইউপিতে পুলিসে নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল হয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে। তার মধ্যেই বিষাদের খবর, যোগীরাজ্যে এক উচ্চ শিক্ষিত যুবক চাকরি না-পেয়ে আত্মঘাতী! নিজেকে শেষ করে ফেলার আগে পুড়িয়েছেন তাঁর ‘অজাকের’ সার্টিফিকেটগুলো! বয়স্ক পিএফ পেনশনারদের সঙ্গে মোদি সরকারের ‘প্রতারণা’র অবসান হয়নি এখনও। সবধরনের শ্রমিকের প্রকৃত আয় দীর্ঘদিন যাবৎ ‘স্ট্যাগন্যান্ট’। তার মধ্যে আছেন কৃষি শ্রমিকরাও। কৃষিপণ্যের এমএসপি-বঞ্চনার আঁচ সাগরপারের দেশগুলিতেও পৌঁছে গিয়েছে। অথচ, ‘আচ্ছে দিন’-এ জিনিসপত্র অগ্নিমূল্য বললেও কম বলা হবে। এনএসএসও-ই বলছে, সংসার খরচ বেড়েছে মনমোহন জমানার আড়াই গুণ!
এরই পাশে রাখুন—ইলেক্টোরাল বন্ড কিসসা, বিলকিস বানোর প্রতি অবিচার, মণিপুর পরিস্থিতি, মহিলা কুস্তিগিরদের সঙ্গে জঘন্য ব্যবহার, বুলডোজ প্রশাসন, ট্যাক্স টেররিজম, এনআরসির রক্তচক্ষু, অপারেশন লোটাস বা ঘোড়া কেনাবেচা এমনকী সংসদের বুকে দাঁড়িয়েও গণতন্ত্র হত্যা প্রভৃতি ইস্যু। ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ সরকারের সামনে একের পর এক ধারালো কাঁটার চেহারায় খাড়া হয়ে আছে এগুলো। বিন্দুমাত্র রাজনৈতিক সততা থাকলে গেরুয়া শিবিরের কারও মুখেই কোনও আস্ফালন আসত না, তাঁরা সবাই মুখ লুকোতেন একসঙ্গেই। তা নিশ্চয় করবেন না কাচের ঘরের বাসিন্দারা। অতএব, সংবাদ মাধ্যম এবং বিচার ব্যবস্থার উচিত আরও নিষ্ঠার সঙ্গে এই জমানার সবগুলো বেড়ালকে ঝুলি থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনা। বৃহত্তম গণতন্ত্রকে বাঁচানোর মূল দায়িত্ব বিরোধীদের। এই সুবর্ণ সুযোগ তাদের মহাজোট ‘ইন্ডিয়া’কে নিতেই হবে। মোদি এবং তাঁর গেরুয়া শিবির এখন আর কোনও দুর্গের নাম নয়, এমনকী নয় সুদৃশ্য সৌধও, একটা কাচের ঘরে পরিণত করেছেন তাঁরাই। একটা ঢিল ঠিকঠাক লেগে গেলে চুর চুর হয়ে ভেঙে পড়বে! কিন্তু সবরকমে বাগে পেয়েও বিরোধীরা ব্যর্থ হলে তাদের শক্তি, ভবিষ্যৎ দুটো নিয়েই দীর্ঘ হবে প্রশ্নচিহ্ন।