এলেন, দেখলেন এবং ফিরে গেলেন। উদ্দেশ্য ছিল জয় করার। কিন্তু পারলেন কি? বঙ্গ বিজেপিকে অক্সিজেন জোগাতে এসে অমিত শাহ বাড়িয়ে দিলেন অস্বস্তি। তুলে দিয়ে গেলেন একগুচ্ছ প্রশ্ন। কী সেই প্রশ্ন? এক, অমিত শাহ বাংলা থেকে তাঁর ৩৫ আসনের দাবির কথা কেন কর্মীদের ফের স্মরণ করিয়ে দিলেন না? দুই, দেড় ঘণ্টা সময় নিয়ে এসেও কেন ৪০মিনিটেই সভাস্থল ছাড়লেন? কেনই বা ভাষণ দিলেন মাত্র ২৩ মিনিট? তিন, একুশে জুলাইয়ের ভিড়ের সঙ্গে টক্কর নেওয়া সম্ভব নয় জেনেও কেন তিনি ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে সভা করায় সম্মতি দিলেন?
অমিত শাহ যেদিন বীরভূমে দাঁড়িয়ে ৩৫ আসনে জেতানোর ডাক দিয়েছিলেন, সেদিন বিজেপি নেতারাও চমকে গিয়েছিলেন। কিন্তু মুখে কিছু বলেননি। কারণ তিনি দলের নম্বর টু। তার উপর দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাই তাঁর কথাকেই বেদবাক্য মনে করে বঙ্গ বিজেপির নেতারা ৩৫ আসনের বুলিই আওড়ে গিয়েছেন। অমিতজি পুজো উদ্বোধনে এরাজ্যে এলেও রাজনীতির কথা বলেননি। সব তুলে রেখেছিলেন ধর্মতলার সভার জন্য। তাই শুধু বিজেপির কর্মী সমর্থকদেরই নয়, গোটা বাংলার নজর ছিল তাঁর ভাষণে।
ধর্মতলার মঞ্চে তিনি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মুষ্ঠিবদ্ধ দু’হাত উপরে তুলে অনেক হুঙ্কার দিলেন, কিন্তু একটিবারও ৩৫ আসনের কথা মুখে আনলেন না। তাহলে কি অমিতজিও বুঝেছেন, এসব বলে তিনি বাংলার মানুষের কাছে হাসির খোরাক হচ্ছেন! তবে, বিজেপির ‘অন্দর কী বাত’ শোনা গিয়েছে সর্বভারতীয় কেন্দ্রীয় সম্পাদক অনুপম হাজরার গলায়, পাঁচটা আসন পেতেই দম বেরিয়ে যাবে। হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিতে পারেন আশঙ্কা করেই বঙ্গ বিজেপি তাঁকে ধর্মতলার সভায় ডাকার সাহস পায়নি। কে আর অপ্রিয় সত্য শুনতে চায়?
আসন সংখ্যা না বললেও অমিত শাহ লোকসভা ভোটের বাজনাটা বাজিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলা থেকে বিজেপিকে এত আসনে জেতানো হোক, যে মোদি বলতে পারেন, এই রাজ্যের জন্যই তিনি তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।’ অমিতজির এই কথাতেই স্পষ্ট, শুধু বাংলায় নয়, গোটা দেশেই বিজেপির অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। তাই লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য তাদের ‘বঞ্চিত বাংলা’র দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। তাহলে কি এবার নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা গলার শিরা ফুলিয়ে বলতে পারবেন না, ‘অব কি বার তিনশো পার’!
এবারের অমিত শাহের ভাষণে বিজেপির কর্মী-সমর্থকরা কতটা হতাশ হয়েছেন, জানা নেই। তবে, বঙ্গ কংগ্রেসের ও সিপিএমের নেতারা রীতিমতো মুষড়ে পড়েছেন। সিবিআই এবং ইডি রাজ্যের একের পর এক তৃণমূল নেতা, মন্ত্রী ও প্রভাবশালীকে গ্রেপ্তার করছে। চলছে লাগাতার তল্লাশি। কিন্তু কংগ্রেস ও সিপিএম নেতারা তাতে খুশি হতে পারছেন না। তাঁদের দাবি, ‘মাথা’ পর্যন্ত পৌঁছতে হবে। ভাবখানা এমন যে মাথাকে ধরলেই তাঁরা টুপ করে গিয়ে কুর্সির দখল নেবেন। সেই ছকেই তো চালানো হয়েছিল ক্যাম্পেন, ‘একুশে রাম, ছাব্বিশে বাম।’
সিপিএম নেতৃত্ব ভেবেছিল, উত্তরকাশীর র্যাট হোল মাইনারদের মতো কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও কলকাতায় এসে ‘মাথা’র কাছে পৌঁছে যাওয়ার বার্তাই দেবেন। কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। অমিত শাহ তৃণমূল সুপ্রিমোকে কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘আপনি দিনরাত দুর্গানাম জপ করছেন, যাতে এরা আপনার ভাইপোর নাম বলে না দেয়।’ এতে একটা বিষয় স্পষ্ট, কেন্দ্রীয় এজেন্সি এখনও পর্যন্ত যাদের গ্রেপ্তার করেছে তাদের দিয়ে ভাইপোর নাম বলাতে পারেনি। তাই সিপিএম ও বঙ্গ কংগ্রেসের নেতারা মাথা ঠুকলেও ‘মাথা’কে ধরার দাবি আপাতত মিটছে না।
অমিত শাহকে ঘিরে যত বিতর্কই থাক না কেন, তিনি যে পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ তাতে দ্বিমত নেই। হাঁড়ির একটা চাল টিপলেই বুঝে যান, ভাতের কী অবস্থা! বঙ্গ বিজেপির কী হাল, সেটা তিনি ভালোই জানেন। সেই কারণেই কি তিনি কলকাতায় বেশি সময় অপচয় করলেন না? তবে কর্মীদের চাঙ্গা করতে সিএএ ইস্যুটি ফের ভাসিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। লক্ষ্য মতুয়া ভোট।
২০১৯ সালে সংসদে সংশোধিত নাগরিক আইন পাশ হয়েছে। একুশের ভোটের আগে বলা হয়েছিল, করোনার প্রকোপ কমে গেলেই লাগু হবে আইন। কিন্তু দু’বছরে কেউ এনিয়ে টুঁ শব্দটি করেনি। ফের ভোট আসতে আবার ঝুলি থেকে বেরিয়েছে সিএএ। তাতে মতুয়ারা সন্তুষ্ট না হলেও কেন্দ্রীয় জাহাজ রাষ্ট্রমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর বেজায় খুশি। ফের গাজর ঝোলানোর একটা সুযোগ পেয়ে গেলেন। উনিশের ভোটে এই নাগরিকত্ব ইস্যুই তাঁকে সাংসদ করেছিল। কিন্তু উনিশ আর চব্বিশ যে এক নয়, সেটা শান্তনুবাবুকে কে বোঝাবে?
প্রতিবার দিল্লির বিজেপি নেতারা বাংলায় এসে হুঙ্কার ছাড়েন, এরাজ্যে সিএএ চালু করবই। কেউ আটকাতে পারবে না। প্রতিপক্ষ যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মমতা যদি বাংলায় বাধা হন, বিজেপি শাসিত রাজ্যে আটকাচ্ছে কে? কেন সেখানে সিএএ লাগু হচ্ছে না? আসলে সবটাই ধাপ্পা। প্রথমদিকে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে মতুয়ারাও বুঝতে পারছেন, এটাও বিজেপির আরও একটা রাজনৈতিক গিমিক। ভোট হাতানোর ছক।
অনেকে মনে করছেন, সিএএ-র পর বিজেপি কৌশলে বাংলা ভাগের বিষয়টাও উস্কে দেবে। কারণ বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত উত্তরবঙ্গে বিজেপি মোটামুটি ভালো জায়গায় ছিল। কিন্তু ধূপগুড়ি উপ নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় বিজেপিও বুঝেছে, উত্তরবঙ্গের ভিতও নড়ে গিয়েছে। অনন্ত মহারাজকে রাজ্যসভায় পাঠানোটা হয়েছে ভস্মে ঘি ঢালা। তাতে দলের কোনও ফায়দা হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে উত্তরবঙ্গে আসন ধরে রাখতে গেলে রাজ্য ভাগের দাবিকে সমর্থন করা ছাড়া বিজেপির আর কোনও উপায় নেই। উত্তরবঙ্গের বিজেপির নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময় আলাদা রাজ্যের দাবি জানিয়েছেনও। লোকসভা ভোটের আগে ফের এই বিষয়টি বিজেপি উস্কে দিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে, সেটা করলে দক্ষিণবঙ্গে বিজেপির কফিনে শেষ পেরেকটাও পোঁতা হয়ে যাবে। অমিত শাহের সভা ফ্লপ না সফল, তা নিয়ে চলছে জোর চর্চা। বিজেপির দাবি, সভা সফল হয়েছে, প্রচুর লোক এসেছিল। তৃণমূলের দাবি, অমিত শাহের সভা ফ্লপ। এই ইস্যুতে পরস্পর বিরোধী মতই প্রত্যাশিত। তবে, বিজেপির বিধানসভায় বিক্ষোভ কর্মসূচিই বুঝিয়ে দিয়েছে, অমিতজির সভা সফল না ফ্লপ!
বিজেপির ধর্মতলায় সভার দিনই তৃণমূল কংগ্রেস বিধানসভা চত্বরে কেন্দ্রের বঞ্চনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচি নিয়েছিল। সেই বিক্ষোভে তৃণমূলের বিধায়কদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীও ছিলেন। সাধারণত দিল্লির কোনও বড় নেতার বাংলায় সভা থাকলে সেটাই হয় রাজ্য রাজনীতির চর্চার বিষয়। সেক্ষেত্রে অমিত শাহের ধর্মতলার সভা এবং তৃণমূলের বিধানসভার বিক্ষোভই আলোচনায় প্রাধান্য পেত। কিন্তু সেটা হল না। কারণ সভা শেষ হতেই বিজেপির বিধায়করা ছুটলেন বিধানসভায় বিক্ষোভ দেখাতে। তাতে চর্চার বাইরে চলে গেল অমিত শাহের সভা। গুরুত্ব পেল উভয়দলের বিধায়কদের চোর, চোর স্লোগান। তাই উঠছে প্রশ্ন, অমিত শাহের সভায় ভিড় নিয়ে চর্চার অভিমুখ ঘোরাতেই কি বিজেপির এই বিক্ষোভ?
ধর্মতলার সভা সফল করতে বঙ্গ বিজেপির চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। আদালতে রীতিমতো লড়াই করে ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে সভার অনুমতি আদায় করেছিল। সেই সভায় লোক আনার জন্য জেলায় জেলায় গিয়ে রাজ্য বিজেপির নেতারা মিটিং করেছিলেন। কর্মী-সমর্থকদের আনার জন্য পর্যাপ্ত বাস এবং ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মিটিংয়ে প্রচুর ভিড় হবে ধরে নিয়ে রান্নাবান্নাও হয়েছিল। আয়োজনের কোনও ত্রুটি ছিল না। একেবারে ২১ জুলাইয়ের ফরম্যাট। শীতের আমেজ গায়ে মেখে বাংলার বুকে আরও একটা ‘একুশে জুলাই’ করে দেখাতে চেয়েছিল বঙ্গ বিজেপি। কিন্তু পারল না। কারণ বাংলায় একুশে জুলাই আর পাঁচটা দিনের মতো নয়। শহিদের রক্তের বিনিময়ে অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন। তাই একুশে জুলাই লক্ষ লক্ষ বাঙালির ‘আবেগ’। আর যাই হোক, আবেগের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলে না।