পাঁচ রাজ্যের ভোটে তিনি প্রচারে যাননি, তাঁর দলও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে না। কিন্তু না থেকেও তিনি আছেন ষোলো আনা। বোঝা গেল, এখনও তিনিই ভারতীয় রাজনীতির এক নম্বর চালিকাশক্তি। সমালোচনা করতেও আবার অনুসরণ করতেও। তিনি না থাকলে বিরোধী জোট জৌলুস হারায়, আবার উপস্থিত হলে কার পাশে বসলেন, রাহুল, লালু না ইয়েচুরি। তা নিয়ে বঙ্গ রাজনীতিতে ঝড় বয়ে যায়। সদ্যসমাপ্ত দু’দিনের সফল শিল্প সম্মেলন দেখে কেউ অতীত ইতিহাস ঘেঁটে তির্যক হাসি হাসে। আবার এক অঙ্গরাজ্যে দেশ বিদেশের তাবড় শিল্পপতিদের এমন ‘মহাকুম্ভ’ দেখে কারও ঈর্ষা হয়। ৪ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ দেখে চোখ কপালে ওঠে। তাঁকে শায়েস্তা করতে ইডি, সিবিআই সবাই কোমর বাঁধে। তাতেও কাজ না হলে এজেন্সি দিয়ে গোটা দলটাকে জেলে পোরার চক্রান্ত তৈরি হয় দিল্লিতে শাসক গেরুয়া শিবিরের সাততারা প্রাসাদে। আবার রাজ্যে রাজ্যে ভোটের লড়াই কঠিন হলে তাঁর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী সহ জনমুখী প্রতিটি প্রকল্প বেমালুম চুরি থুড়ি কপি করে বিজেপি, কংগ্রেস সহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। বামেরা নাক সিঁটকোয়। তবু এই বঙ্গে কারওর ভোটব্যাঙ্ক ফেরে না। তাঁর ব্যক্তিত্বের মাহাত্ম্যে বাকিদের জামানত জব্দই ভবিতব্য।
এত আঘাত সত্ত্বেও ভোটবাক্সে তাঁর ম্যাজিক অটুট থাকে কী করে, তার তল খোঁজা ভার। রাজনীতিতে চার দশকেরও বেশি সময় কাটিয়েও ঘৃণা, অবহেলা, অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসন্ন চব্বিশ সালের মহারাজনৈতিক প্রলয়ের প্রাক্কালেও তিনি সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। এবং ১২ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকার পরও দেশের এক নম্বর স্ট্রিট ফাইটার। তৃণমূলে স্বাধীনতা কতটা, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অথচ সেই দলেরই মুখপাত্র প্রকাশ্যে সরকারি কাজের সমালোচনা করার সাহস পান। প্রতিক্রিয়া জানতে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে প্ল্যানচেট করার ইচ্ছা হয়। লঘু দোষে গুরু দণ্ড হয়েছিল তাঁর। আর মমতার তৃণমূলে? যে যাই বলুন, যতই কাদা ছেটান, এক বিরল ব্যক্তিত্বের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁরা তাঁর সমালোচনা করেন, উঠতে বসতে কটাক্ষ ছুড়ে দেন, তাঁরাই আবার ভোট বৈতরণী পার হতে তাঁর নীতিই অনুসরণ করেন অবলীলায়।
তাঁর দলের কারও দশ, বিশ, চল্লিশ কোটি টাকার সম্পত্তি বাড়লে ইডি ঘরে সিঁধ কাটে। আর রাজস্থানে পাঁচ বছরে কোনও বিজেপি বিধায়কের প্রায় একশো কোটির সম্পত্তি বাড়লেও সবাই চুপচাপ। গেরুয়া প্রোটেকশন! এজেন্সি ত্রিসীমানা মাড়ায় না।
দুটো উদাহরণ দেব: সিদ্ধিকুমারী। বয়স ৫০। বিকানির পূর্ব বিধানসভা আসনে বিজেপি প্রার্থী। চতুর্থবার বিধায়ক হওয়ার জন্য লড়ছেন। সবে রাজস্থানে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। বিগত পাঁচ বছরে সিদ্ধিকুমারীর সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণ ২৪ গুণ। ২০১৮ সালে শেষ যেবার রাজস্থানে ভোট হয়, তখন তাঁর সম্পত্তি ছিল ৪ কোটি ৬৬ লক্ষ। আর এবার ভোটে তিনি যে খতিয়ান দিয়েছেন তাতে ধনসম্পদ বেড়ে হয়েছে ১০২ কোটি ২৭ লক্ষ। নিট বৃদ্ধির পরিমাণ সাড়ে ৯৭ কোটি টাকা। তবু তিনি জানেন, আয়কর দপ্তর, ইডি, সিবিআই কেউ তাঁর এই ‘সৎপথ’-এ চমকপ্রদ ফুলে ফেঁপে ওঠার কিস্সা দেখে মুচকি হাসলেও দিনেরাতে কখনও দরজায় কড়া নাড়বে না। প্রশ্ন তুলবে না। বাড়িতে ঢুকে লকার, ব্যাঙ্কের কাগজপত্র ঘাঁটবে না। কারণ, তিনি কেন্দ্রের শাসকদলের সক্রিয় নেত্রী এবং বিধানসভা ভোটে বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী। এটাই স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এক রাজনীতিকের শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ! আগামী রবিবার রাজস্থানে পালাবদল হলে তিনি গেরুয়া সরকারের মন্ত্রীও হয়ে যেতে পারেন। পাঁচ বছর পরে, ২০২৮ সালে যখন আবার রাজস্থানে ভোট হবে তখন সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণ ৪৮ গুণ হয় কি না, সেদিকেই নজর থাকবে সবার। আর মোদিজির এক দেশ এক ভোটের চক্করে নির্বাচনটাই না মুছে যায় তাহলে ওসব হিসেব দেওয়ার দায়ই থাকবে না কারও।
লাফিয়ে সম্পদ বৃদ্ধির তালিকায় আর এক উদাহরণ, গেরুয়া দলের চেতন কাশ্যপ। বয়স ৫৪। আর এক সদ্য বিধানসভা ভোট সম্পন্ন হওয়া রাজ্য মধ্যপ্রদেশের রতলাম সিটি কেন্দ্রের প্রার্থী। পাঁচ বছরে তাঁর সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৯২ কোটি টাকা। পাঁচ বছর আগের ভোটে চেতনের সম্পদের পরিমাণ ছিল ২০৪ কোটি টাকার মতো। চলতি বছরের নির্বাচনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯৬ কোটি। তিনিও বিলক্ষণ জানেন ইডি, সিবিআইয়ের নজর যেহেতু শুধু পশ্চিমবঙ্গে, আরও নির্দিষ্টভাবে তৃণমূলের দিকে, তাই তাঁর সম্পত্তি বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলে কার সাধ্য? কেন্দ্রীয় এজেন্সির নজর আপাতত ইন্ডিয়া জোটের সদস্যদের দিকে, যাতে চব্বিশের লড়াইয়ের আগে জেলে পুরে তাঁদের সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া যায়। গেরুয়া নেতানেত্রীদের সম্পদ, স্থাবর ও অস্থাবর যতই বাড়ুক, তার বিন্দু বিসর্গ খতিয়ে দেখার কোনও প্রয়োজন নেই। স্বয়ংশাসিত ইডির কর্তারা জানেন, ওটা ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ এর পরিপন্থী। নিষিদ্ধ প্রসঙ্গ। তাই যত রেইড, যত তল্লাশি সব তৃণমূল, আপ সহ বিরোধী শাসিত রাজ্যে। এবং অবশ্যই অবাধ্য শিল্পপতিদের ডেরায়। তাঁরাও টের পাচ্ছেন এই আমরা-তোমরার টানাপোড়েন। একদল শিল্পপতি হাজার হাজার কোটির সম্পদ লুটে নিয়ে দিব্যি বিদেশে বহাল তবিয়তে। সঙ্গে বিদেশের পরিষ্কার আবহাওয়া। এদেশের দূষণ তাঁদের আয়ু কমাচ্ছে না। আর যাঁরা কেন্দ্রের শাসকদলকে পুজো না দিয়েই ব্যবসা করছেন, তাঁদের ঘরে রোজ হানা। টুঁটি চেপে ধরার সবরকম আয়োজন। রাজনীতিকদের মতোই ব্যবসায়ীরাও তাই ‘আমরা ওরা’র গেরোয় দু’ভাগ। আর গরিব মানুষের চাকরি নেই, ব্যবসা লাটে এবং মূল্যবৃদ্ধি চরমে। তাহলে লাভবান কারা?
এই আবহেই অষ্টাদশ সাধারণ নির্বাচনের পাঁচ মাস আগে পাঁচ রাজ্যের ভোটের ফল বেরবে আগামী রবিবার। মধ্যিখানে সাত দিন, ১৬৮ ঘণ্টা। তারপর সকাল হতেই একে একে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থানে কোন দলের সরকার গঠিত হবে তার খতিয়ান জানার পালা। রেউড়ি বনাম রেউড়ির যুদ্ধে শেষ হাসি হাসবে কে? মোদির বিজেপি না রাহুলের কংগ্রেস। বলা বাহুল্য, এই পাঁচ রাজ্যের ফলই গড়ে দেবে শাসক, বিরোধীদের ভবিষ্যৎ। ছ’মাস পর কে দখল করবে দিল্লির ক্ষমতা, ইঙ্গিত মিলবে তারও।
রেউড়ি কথাটা এই বঙ্গে মোটেই খুব পরিচিত নয়। কিন্তু চলতি পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন পর্বে সম্ভবত সর্বাধিক আলোচিত শব্দবন্ধ। কেন? কারণ ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে সেই রেউড়ি বিলানোয় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি। গোটা হিন্দি বলয়ে। পিছিয়ে নেই কংগ্রেসও। অথচ এই সেদিনও এই পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির বিরুদ্ধে ছিলেন বিজেপির থিঙ্কট্যাঙ্করা। প্রথমটায় ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন ১০০ দিনের কাজেরও। ভর্তুকি তুলে দেওয়ার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু নোটবন্দি যেমন কালো টাকার ত্র্যহস্পর্শ থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারেনি, তেমনি কর্মসংস্থান, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের মতো বেসিক কাজগুলি করতেও ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রের বিগত দশ বছরের সরকার। তাই অগত্যা নথ ভেঙে রেউড়িতেই আস্থা। আবার শোনা যাচ্ছে, মমতার কন্যাশ্রীর ধাঁচে কেন্দ্রীয় সরকারও আনছে রমণীদের মন জয় করা আকর্ষণীয় প্রকল্প।
বিজেপির সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে কংগ্রেসও অনেকটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথই অনুসরণ করছে। রাজস্থানে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, তা সম্ভবত এবারের সবচেয়ে কঠিন লড়াই। সেখানে কংগ্রেসের হয়ে একা লড়াইয়ে অবতীর্ণ ৭২ বছরের চির যুবক অশোক গেহলট। যদি তিনি এই নির্বাচনে জয়ের হাসি হাসেন, তাহলে কংগ্রেসের ইতিহাসে অন্যতম সফল মুখ্যমন্ত্রীর সম্মান পাবেন। অভিমানে হতে পারে কিংবা প্রবল হতাশা, এই লড়াইয়ে সেভাবে বুক চিতিয়ে লড়তে দেখা যায়নি শচীন পাইলটকে। কিন্তু তবুও কংগ্রেস জিতবে এবং সেই জয় আসবে সম্পূর্ণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফর্মুলায়। গেহলট ঘোষণা করেছেন, ভোটে জিতে এলে মহিলাদের বছরে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হবে। মমতার লক্ষ্মীর ভাণ্ডারেরই রিমেক দেখছে রাজস্থান। ৫০০ টাকায় রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার। ২ টাকা কেজি দরে গোবর। মহিলাদের জন্য মোবাইল। ল্যাপটপ। এছাড়া স্বাস্থ্যবিমা। একদম মমতার পথেই মোদিজির রাজস্থান জয়ের স্বপ্ন রুখে দেওয়ার কৌশল নিয়ে এগিয়েছেন গেহলট। মধ্যপ্রদেশে কমল নাথের পাশে আছেন দিগ্বিজয় সিং’রা। অনেকটা শোলের ‘জয় আর বীরু’র মতো। কিন্তু রাজস্থানে একা কুম্ভ রক্ষায় ব্রতী ৭২ বছরের চির তরুণ গেহলটজি। আগামী রবিবার ফল বেরলে যদি তিনি পারিবারিক জাদু ব্যবসার কিছুমাত্র ঝলক দেখাতে পারেন তাহলে শুধু রাজস্থান নয়, গোটা দেশে বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের পালে দমকা হাওয়া খেলে যাবে। রাজ্যে রাজ্যে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হবে এবং মোতেরা স্টেডিয়ামে যেভাবে প্রধানমন্ত্রীর চোখের সামনে টিম ভারতকে অল্পের জন্য ক্রিকেট বিশ্বকাপ হারাতে হয়েছে, তেমনি টিম মোদি-শাহকে দিল্লির গদি হারাতে হবে! আবারও প্রমাণ হবে, ভারতীয় গণতন্ত্রে ব্যক্তি পুজোর স্থান সীমিত। এদেশে গণতন্ত্রের ৭৫ বছরের অভিযাত্রায় এমন চেষ্টা যে এই প্রথম, তা বলা যাবে না। আগে হয়েছে এবং একইসঙ্গে সেই শাসককুলকে পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান করে সাধারণ নাগরিকরা প্রমাণ করে দিয়েছেন, এদেশে শেষকথা বলবে মানুষ। কোনও ধর্ম, বিশ্বাস, প্রতিস্পর্ধী মত ও পথকে অসম্মান না-করেও দেশ চলবে সাধারণ নাগরিকের দৈনন্দিন চাহিদা মেনে। কোনও নেতা কিংবা কোনও বিশেষ ধর্মীয় সংগঠনের গোলামি করে নয়। এই সংবিধানকে সংখ্যার জোরে চুপ করিয়ে দিয়ে নিজের দিকে ঝোল টানতে যে-ই সচেষ্ট হবে, ইতিহাস মুছে দেবে তাঁকেই।
আগামী ৩ ডিসেম্বর তাই ভারতীয় রাজনীতির উত্থান-পতনের এক অবিচ্ছিন্ন কালখণ্ড শুধু নয়, গণতন্ত্রের উৎসবের নতুন অধ্যায়ের শুভ মহরতও। চব্বিশের উত্থান-পতন, রাজনৈতিক ওঠা-পড়ার দিগ্নির্দেশ শোনার অপেক্ষায় আমরা অধীর। সংবিধান বাঁচবে না ব্যক্তিতন্ত্র। আগামী রবিবারই তার ফয়সালা।