বিশেষ নিবন্ধ

সিপিএমের অস্তিত্ব সঙ্কট
সমৃদ্ধ দত্ত

আমরা অনেকেই যারা গত ১৫ বছর ধরে প্রতিবেশীর সঙ্গে জমি আর পাঁচিল দেওয়া নিয়ে ঝগড়া মেটাতে পারছি না, তারাও দিনভর জঙ্গলমহল কিংবা দার্জিলিং নীতি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কী করা উচিত সেই নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিই। এবং মনে করি আমাদের সেইসব মতামতের বিরাট মূল্য আছে। আমরা যারা অফিস অথবা কর্মস্থলে কলিগের নিরন্তর চক্রান্ত আর শত্রুতার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপই নিতে পারি না, তারা নরেন্দ্র মোদিকে উপদেশ দিয়ে থাকি, কীভাবে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাক অধিকৃত কাশ্মীর দখল করে নেওয়া উচিত। আমরা যদি বলি আমার রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে কিছু বলার আছে, আপনারা রবিবার বিকেলে পাড়ার লাইব্রেরির রিডিং রুমে কিন্তু আমার বক্তব্য শুনতে আসবেন, সাতজন আসবেন কি না সন্দেহ আছে। অথচ যাঁরা বছরের পর বছর একাই লক্ষ লক্ষ মানুষকে জড়ো করে ফেলেন তাঁদের সমাবেশে অথবা পদযাত্রায় একক ক্যারিশমায়, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্র মোদি কিংবা রাহুল গান্ধীদের নানাবিধ পরামর্শ ও সমালোচনা উভয়ই দিয়ে থাকি হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুক, আড্ডা, তর্কে সর্বত্র। অর্থাৎ সোজা কথায় আমরা নিজেরা কী করে উঠতে পারলাম জীবনে, আমাদের গুরুত্ব অথবা সাফল্য কতটা আমাদের পারিপার্শ্বিকে, সেটা ভাবিই না। আমার ক্ষমতা কতটা সেটা বিবেচনার তুলনায় অন্যদের ব্যর্থতার প্রতি আঙ্গুল তুলি, সমালোচনা করি এবং বিদ্রুপও করে থাকি। 
আমাদের মতো সাধারণ মানুষ সমাজে কী নিয়ে থাকবে? অতএব এই অভ্যাসগুলি অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি প্রবণতা। কারণ, আমরা রাজনীতির ময়দানে নামছি না, কোনও হাই প্রোফাইল পদ আমাদের লক্ষ্য নয়, ভারত নামক রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে অথবা পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যের গতিপ্রকৃতি কী হতে চলেছে, সেসব আমাদের দ্বারা নির্ধারিত হবে না। আমরা সামান্য লোক। অথচ ঠিক এখানেই বিস্ময় তৈরি হয় যখন রাজনৈতিক দলগুলির আচরণও ঠিক এরকমই অতি সাধারণ হয়ে যায়। 
এই যেমন সিপিএম। সিপিএম কর্মী সমর্থকদের কাছে সবথেকে বড় বেদনাদায়ক মনোভাব হওয়া উচিত যে, তাদের এই ঐতিহ্যশালী দলটি  ক্রমেই কীভাবে রাজনৈতিক চেতনা, বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন এবং মেধাচর্চা থেকে সরে এসে একটি মোটাদাগের পাড়ার ক্লাবে পরিণত হয়ে গেল। যে ক্লাব অন্য একটি প্রতিযোগী ক্লাবের পুজোয় কেন বেশি ভিড় হয় এবং মানুষ কেন বেছে বেছে ওই ক্লাবের রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানেই ভিড় জমায় সেটি নিয়ে প্রচণ্ড রাগ করে। অথচ এই আত্মসমীক্ষা করে না যে, আমাদের কী ভুল হচ্ছে অথবা আমরা কেন মানুষকে আকর্ষণ করতে পারছি না। নিজেদের সমালোচনা করার তুলনায় সারাক্ষণ সফল ক্লাবের অর্থহীন সমালোচনা করে চলে। সিপিএম সারাক্ষণ তৃণমূল অথবা তাদের নেত্রীর সমালোচনা করে। খুব ভালো। করুক। কিন্তু সিপিএমকে কেন মানুষ প্রত্যাখ্যান করছে এরকম বারংবার? সেটা নিয়ে সিপিএম যে ভাবিত সেটা তাদের আচার আচরণ দেখে মনে হয় না। 
যে সিপিএম এককালে বাংলার রাজনীতিকে আন্তর্জাতিকতা শিখিয়েছিল, যাদের প্রিয় মন্ত্রসঙ্গীতের নামই ইন্টারন্যাশনাল, আজ তারা সম্পূর্ণ কূপমণ্ডুক দলে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার চর্চা নেই। বিদ্যার চর্চা নেই। পার্টি ক্লাস, পার্টি চিঠির কোনও গুরুত্ব নেই। সেগুলো করার মতো শিক্ষিত মানুষও ক্রমেই অবলুপ্ত। কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার ১০০ বছর আসন্ন। অথচ সিপিএম এখন মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, সমাজতন্ত্র সব ছেড়ে নিখাদ মমতা বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে। সামান্যতম হোমওয়ার্ক করেন না অধিকাংশ নেতা। 
জি টুয়েন্টি সম্মেলনে রাষ্ট্রপতির নৈশভোজে যোগ দিতে একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন গিয়েছেন? এই প্রশ্ন তুলে সিপিএম এবং রাজ্য কংগ্রেস তীব্র সমালোচনা করেছে। প্রশ্ন তুলেছে মমতা কি মোদির সঙ্গে সেটিং করতে গিয়েছেন? কেন তিনি বয়কট করলেন না? অথচ নীতীশকুমার, হেমন্ত সোরেন, এম কে স্ট্যালিন, হিমাচলের কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী সুখবিন্দর সিং সুখু, সকলেই যোগ দিয়েছেন। সেই তথ্য জেনেও আক্রমণ করা হলে তার থেকে বুদ্ধিহীনতা আর কী হতে পারে?
মহাকাশচারী রাকেশ শর্মাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাকেশ রোশন বলে উল্লেখ করেছেন। সিপিএম ঝাঁপিয়ে পড়ে দিনের পর দিন সেই নিয়ে বিদ্রুপ, ব্যঙ্গ, শ্লেষ করেছে। কিন্তু তারপরই দেখা গেল ধূপগুড়ি বিধানসভার উপনির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল জিতে গিয়েছে। শুধু পরাস্ত হওয়া না, সিপিএমের জামানত বা‌঩জেয়াপ্ত হল। তারপর বিগত কয়েকদিন ধরে কেউ কি দেখেছেন, সিপিএম ওই পরাজয় নিয়ে কোনও আত্মপর্যালোচনা করছে? বরং জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার পর সিপিএম প্রশ্ন করেছে মমতা কেন রাষ্ট্রপতির ডিনারে গেলেন! 
শুধু ধূপগুড়ি কেন? সেদিন একসঙ্গে গোটা ভারতের সাতটি বিধানসভা ভোটের উপনির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। ইন্ডিয়া জোট চারটি আসনে জয়ী। এনডিএ জোট তিনটি আসনে। এই ফলের আড়ালে একটি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য রয়েছে। এই সাতটি আসনের মধ্যে কোথাও কংগ্রেস জিতেছে, কোথাও তৃণমূল জিতেছে, কোথাও ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা জিতেছে। ঠিক যেখানে সিপিএমের উপর দায়িত্ব ছিল বিজেপিকে হারিয়ে ইন্ডিয়া জোটকে জেতানোর, সেখানেই সিপিএম ব্যর্থ। অর্থাৎ ত্রিপুরার দুই আসনেই সিপিএম হেরে গিয়েছে। আবার ধূপগুড়ি এবং কেরলের একটি উপনির্বাচনেও সিপিএম পরাজিত হয়েছে। যেখানে ভোট হচ্ছে, সিপিএম হেরে যাচ্ছে কেন? সিপিএম ভাববে না? সিপিএম আদর্শচ্যুত, লক্ষ্যচ্যুত এবং সমর্থনচ্যুত হয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই।  সিপিএম যদি সিরিয়াসলি মনে করে যে তারা বাংলায় পালাবদল ঘটাবে অথবা রাজনীতিটা গুরুত্ব দিয়ে করবে, তাহলে যে আচরণ ও রাজনৈতিক কর্মসূচি তাদের নেওয়ার কথা ছিল, তার সামান্যতম লক্ষণ দেখা যায় না। সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলছে এরকম জনস্বার্থের ইস্যু নিয়ে লাগাতার সিপিএম রাস্তায়, মাঠে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এরকম দেখা যাচ্ছে? বরং নিজেরাই সেইসব ইস্যুকে দুর্বল করে দিয়েছে। 
মার্কসবাদের প্রধান লক্ষণ প্রোলেটারিয়েট রেভলিউশন। সিপিএম ১৯৬৪ সালে নিজেদের দল ভেঙে আলাদা দল গঠন করার মাত্র তিন বছরের মধ্যে সরকারে যোগ দিয়েছে। কোথায় রেভলিউশন? বরং সরকারে আসার পর শ্রমিকের শ্রম বন্ধ করে দিয়েছে সিটু। একের পর এক ফ্যাক্টরিতে তালাচাবি ঝোলানোর ব্যবস্থা করেছে। মরিচঝাঁপি থেকে সিঙ্গুর। একটি আদর্শচ্যুতির ইতিহাস। 
যে সিপিএম আন্তর্জাতিক ছিল, যে সিপিএম ইনটেলেকচুয়াল ছিল, যে সিপিএম শিক্ষিত ছিল এবং যে সিপিএম একসময় উদ্বাস্তু থেকে শ্রমিক, গরিব ও কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সেই সিপিএম বঙ্গবাসীর সমর্থন পেয়েছিল অকুণ্ঠ। নিছক ভোটে পরাস্ত হয়ে এই আদর্শগুলি থেকে কিন্তু বিচ্যুত হওয়া যায় না। অর্থাৎ অন্য কোনও দল সিপিএমকে পরাস্ত করেনি। সিপিএম নিজেরাই ধীরে ধীরে এই নীতি আদর্শ থেকে সরে গিয়েছে। আর ঠিক সেভাবেই মানুষও সিপিএমের অজান্তে সরে গিয়েছে নিঃশব্দে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপলক্ষ মাত্র। ২০১১ সাল থেকে লাগাতার সিপিএম নিজেরাই নিজেদের হারিয়ে চলেছে। বিগত বছরগুলির দিকে সিপিএম একবার মুখ ঘুরিয়ে দেখুক। দেখতে পাবে শুধু ভোটব্যাঙ্ক নয়, সিপিএম ক্রমাগত হারিয়ে চলেছে উচ্চচেতনার রাজনীতি, নিজেদের আদর্শ, নেতৃত্বের ভাষা, রাজনৈতিক শিক্ষা। একসময় মার্ক্সবাদী দলের প্রতিপক্ষ ছিল দারিদ্র্য, অশিক্ষা, শোষণ ও পুঁজিবাদ! আর আজ সেই দলে একমাত্র প্রতিপক্ষ একজন মানুষ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। 
১৯৩৯ সালে লাহোরে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। তার নাম ছিল ‘মার্কসসিজম ইজ ডেড’। সেখানে বলা হয়েছিল ‘মার্ক্সবাদের কবর খুঁড়েছে রাশিয়া’। পশ্চিমবঙ্গে অবিকল ওই কথা প্রযোজ্য। সিপিএম এই রাজ্যে মার্ক্সবাদী আদর্শের মৃত্যুর কারণ! সঙ্কট হল, সিপিএমের কর্মী আছে। সমর্থক আছে। তাদের দিশা দেখানোর মতো যোগ্য নেতানেত্রীই নেই। কর্মীদের কাছে এটাই দুর্ভাগ্য। আদর্শও নেই, নেতাও নেই। এই দলকে রক্ষা করবে কে?
11Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

উপস্থিত বুদ্ধি ও প্রখর অনুমান ক্ষমতার গুণে কার্যোদ্ধার। ব্যবসা, বিদ্যা, দাম্পত্য ক্ষেত্রগুলি শুভ।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৩ টাকা৮৪.৮৭ টাকা
পাউন্ড১০৮.৩২ টাকা১১১.৮৭ টাকা
ইউরো৯১.২৫ টাকা৯৪.৪৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
5th     September,   2024
দিন পঞ্জিকা