পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে মুজফফরাবাদ থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে নীলম উপত্যকায় রয়েছে ১৮টি মহাশক্তি পীঠের অন্যতম শারদাপীঠ এবং শারদা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ। এক সময়ে সেই শারদাপীঠের উদ্দেশে তীর্থযাত্রা শুরু হতো কাশ্মীরের তিতওয়াল গ্রাম থেকে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার ঠিক পরেই পাক হানাদারদের আক্রমণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সেই শারদা মন্দির এবং গুরুদ্বার। কিন্তু নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি কাশ্মীরের মানুষের ভাষা। কাশ্মীরি লিপি। যে লিপির ঐতিহাসিক নাম শারদা লিপি। যার উৎপত্তি ব্রাহ্মী লিপি থেকে।
দীর্ঘদিন ধরে তিতওয়াল এলাকায় ওই মন্দির পুনর্নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছিল উপত্যকার পণ্ডিত সমাজ। অবশেষে সেই দাবি পূরণ করেছে মোদি সরকার। নালন্দা-তক্ষশীলার থেকেও প্রাচীন ওই মন্দির-বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিতে কাশ্মীরে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন মন্দির। তবে বিশ্ববিদ্যালয় নয়। গত মার্চে কুপওয়াড়া জেলার তিতওয়াল গ্রামে দেবী শারদার মন্দির ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। স্বাধীনতার পরে এই প্রথম নিয়ন্ত্রণরেখার (এলওসি) গা-ঘেঁষে কোনও মন্দিরের উদ্বোধন। সাফল্যের সুর তুলে শাহ বলেছিলেন, ‘৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের পরে কাশ্মীরের পরিস্থিতি যে শান্ত হয়েছে, তা সীমান্ত এলাকায় ওই মন্দির নির্মাণ থেকেই স্পষ্ট। শুধু হিন্দু মন্দিরই নয়, জঙ্গিরা বিভিন্ন সময়ে যে সুফি তীর্থস্থানগুলি ভেঙে দিয়েছে, সেগুলিও পুনরুদ্ধার করবে মোদি সরকার।’ কিন্তু শুধু মন্দির-সুফি তীর্থস্থান নির্মাণ করলেই কি কাশ্মীরে শান্তি ফিরে আসবে? নাকি জি-২০ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির বৈঠকের আগে কাশ্মীরের শান্তি, সুস্থিতি এবং সৌন্দর্যকে বিদেশি অতিথিদের সামনে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা?
কাশ্মীরে জি–২০ সম্মেলন সফল করতে মোদি সরকার চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। ২২ থেকে ২৪ মে তিন দিনের এই সম্মেলন সার্থক করতে কেন্দ্রীয় সরকার ‘বদলে যাওয়া’ কাশ্মীরকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে চেয়েছে। ব্যাপক প্রচারে তুলে ধরা হয়েছে, এই রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা খারিজ করার পর থেকে কাশ্মীরের হালহকিকত কীভাবে কতটা বদলে গিয়েছে। দেশের সব বড় বড় সংবাদপত্রে তার পাতাজুড়ে বিজ্ঞাপন। প্রচারে নির্যাস: জম্মু–কাশ্মীর উৎফুল্ল ও উল্লসিত। কাশ্মীরবাসীর ‘উৎফুল্ল ও উল্লসিত’ হওয়ার একটি কারণ যদি হয় উন্নয়ন, অন্য কারণ জি-২০ সম্মেলন। কেমন সেই উন্নয়ন, বিজ্ঞাপনে বিস্তারিতভাবে সেই ফিরিস্তি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, কাশ্মীরে উন্নত মানের সড়ক পরিকাঠামো গড়ে তুলতে সরকার খরচ করেছে এক লাখ কোটি টাকা। চারটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির জন্য লগ্নি করেছে ২৫ হাজার কোটি। এই চার প্রকল্প থেকে উৎপাদিত হবে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সংবিধানের ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের পর গত তিন বছরে প্রধানমন্ত্রীর গ্রাম সড়ক যোজনায় তৈরি করা হয়েছে ৬ হাজার ৯১২ কিলোমিটার রাস্তা। রেল যোগাযোগ বাড়াতে চন্দ্রভাগা নদীর উপর তৈরি হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু সেতু। ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারের চেয়েও ৩৫ মিটার উঁচু এই সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল করবে। জম্মু–কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে ন’টি টানেল। খরচ হয়েছে ১৮ হাজার ৫০০ কোটি। এককথায় গোটা জম্মু–কাশ্মীরজুড়ে চলছে বিপুল কর্মযজ্ঞ। বিজ্ঞাপনে মোদি সরকার বোঝাতে চেয়েছে, জম্মু–কাশ্মীরের মানুষ এখন কত খুশি। আর সেই প্রচারের কেন্দ্রে শুধুই প্রধানমন্ত্রী মোদির ছবি। যাঁর প্রতিটি পদক্ষেপেই ক্ষমতা-দর্পণের প্রত্যক্ষ ছায়া।
যিনি দাবি করেন, ষাট বছরে দেশ রসাতলে গিয়েছে, যা কিছু উন্নয়ন গত আট বছরে এবং তিনিই তার রূপকার। সেই প্রধানমন্ত্রী মোদির এখন একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা ও লোকসভা সীমানা পুনর্নির্ধারণের মাধ্যমে ভোট করিয়ে মুসলিম-প্রধান কাশ্মীরে প্রথম কোনও এক হিন্দুকে মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসানো। সরকারের নির্দেশ মেনে লক্ষ্যে পৌঁছতে পরোক্ষে সেই কাজ করেছে ‘ডিলিমিটেশন কমিশন’। কারও কোনও আপত্তি ধোপে টেকেনি। ভূস্বর্গকে ‘আবদুল্লা-মুফতি-গান্ধীমুক্ত’ করাই গেরুয়া শিবিরের একমাত্র এজেন্ডা। তার আগাম রিহার্সাল ছিল শ্রীনগরে জি-২০ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির বৈঠক সফল করা। কিন্তু এভাবে কি কাশ্মীরিদের দেশের মূল স্রোতে ফেরানো যায়?
কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ তো মোদি-শাহরা লিখেই ফেলেছেন! ২০১৯-এর ৫ আগস্টে কাশ্মীর যেদিন হারায় পৃথক রাজ্যের গরিমা, সংবিধানের ৩৭০ ধারা অনুযায়ী বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার অধিকার, দেশজুড়ে হিন্দুত্ববাদীদের প্রবল হর্ষধ্বনিতে ঢেকে গিয়েছিল ঝিলমের স্রোতের আওয়াজ! কাশ্মীর এবং লাদাখকে ভেঙে পৃথক দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ঘোষণা করা হয়েছিল। মনে করুন সেই সময়ে কথা। ৫ আগস্টের এক পক্ষকাল আগে থেকেই কাশ্মীর ডুবে যেতে থাকে গভীর এক ফাঁদে। যে ফাঁদ অনিশ্চয়তা আর বিশৃঙ্খলায় ভরা। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই উপত্যকায় ৩৮ হাজার অতিরিক্ত সেনা ও আধাসেনা পাঠানো হয়। এর আগে মে মাসে অমরনাথ যাত্রার শুরুতে তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত ৪০ হাজার নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা হয়। পরে সেই যাত্রা স্থগিত হয়ে যায় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে। সমাজমাধ্যমে ফাঁস-হওয়া সরকারি সার্কুলার, অত্যাবশ্যক পণ্য মজুতের জন্য অস্বাভাবিক তৎপরতা, বিভিন্ন মসজিদের তালিকা, সেগুলির পরিচালন বোর্ডের সবিস্তার তথ্য চাওয়া— নানা ঘটনাক্রম উপত্যকার ভূমিপুত্রদের কপালের ভাঁজ আরও গভীর হচ্ছিল। তারপরের ঘটনা তো সকলেরই জানা! জম্মু ও কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা, লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত
অঞ্চল বানিয়ে ফেলা, চোখের পলকে ঘটে গিয়েছে সব কিছু...।
মনে পড়ে, যখন কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল শ্রীনগরের বিরিয়ানি খেতে খেতে সব কিছু স্বাভাবিক বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন, সেই সময়ে কাশ্মীরের অন্দরে কী ঘটে চলেছে? একের পর এক নেতাকে জেলে পোরা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ নেতানেত্রীদের গৃহবন্দি করা হয়েছে। পাঁচতারা হোটেলও তখন জেলখানা। বিভিন্ন গেস্ট হাউস বদলে গিয়েছে বন্দিশালায়। বিচ্ছিন্ন মোবাইল পরিষেবা, বিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট। ল্যান্ডলাইনও বিচ্ছিন্ন! রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড, কাঁটাতার, মেশিনগান আর রাইফেল, জলপাইরঙা উর্দি আর বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটের আস্ফালন! প্রধানমন্ত্রী কি ভাবছেন, সেখানকার মানুষের মনে এ সবের কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না? কিংবা এতই সামান্য প্রতিক্রিয়া, যার নিরাময় কিছু মধুর বাক্যের দুরধিগম্য প্রতিশ্রুতি দিয়েই সম্ভব?
আপনি বলবেন, উপত্যকা কতটা শান্ত, দিঘির জলের মতো স্থির, তার প্রমাণ পর্যটকের প্লাবন। দশ বছরের পরিসংখ্যান ভেঙে পর্যটনে কাশ্মীর এবার রেকর্ড করেছে। পহেলগাঁও, গুলমার্গ, সোনমার্গের মতো পর্যটন কেন্দ্রগুলির কাছাকাছি হোটেল এবং অতিথিনিবাসগুলি প্রায় ষোলোআনা পূর্ণ। দু’বছরের কঠিন সময় পেরিয়ে, গত বছর জম্মু এবং কাশ্মীরে প্রায় এক কোটি ৬২ লক্ষ পর্যটকের পা পড়েছিল। যা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সর্বাধিক। কিন্তু পর্যটকদের ঢল যে স্বাভাবিকতার নমুনা নয়, কবুল না করলেও মোদি সরকার তা বোঝে। নিরাপত্তায় ছিটেফোঁটা ঢিলেমিতে তাই তারা রাজি নয়। ‘স্বাভাবিক’ কাশ্মীর আজও তাই নিরাপত্তার ঘেরাটোপেই বন্দি। উপনিবেশ-শক্তির দেখাদেখি ঔপনিবেশিক সমাজ কীভাবে হিংসাকে নতুন করে ধারণ করে, তার বাহক হয়ে উঠে নিজের ক্ষমতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা চায়— কাশ্মীর তার উদাহরণ! উপত্যকা আজও আঙুল তুলে দেখায়, ভারতের মতো দেশে গণতন্ত্রের সঙ্গে এই হিংসা-কাঠামোর সংযোগ গভীর। একই ‘স্পেস’ তারা একসঙ্গে অধিকার করে থাকে...।
১৯৯০-এর দশকে যখন কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপত্যকা থেকে তাড়ানো হচ্ছিল, সেই সময় ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোতে কাশ্মীর গ্রুপের প্রধান ছিলেন অমরজিৎ সিং দুলাত। পরে বাজপেয়ি জমানায় তিনি গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্রধান হয়েছিলেন। এহেন দুলাতের কথায়, মোদি সরকারের বাহুবলী নীতি ও সেনা মোতায়েনের ফলে কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ অনেকটাই কমে গিয়েছে। তবে এর পাশাপাশি কাশ্মীর তার ‘ভারত-বোধ’ হারিয়ে ফেলেছে। নিজের বই ‘আ লাইফ ইন দ্য শ্যাডোস’-এর প্রচারে এসে প্রাক্তন ‘র’ কর্তা জোর গলায় বলেছিলেন, ‘আমি নরেন্দ্র মোদিকে আশ্বাস দিতে পারি, জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হলে তিনি শ্রীনগরে এসে কোনও নিরাপত্তা ছাড়াই খোলা জিপে ঘুরে বেড়াতে পারবেন।’ দীর্ঘদিন কাশ্মীরকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে দুলাতের আশঙ্কা, আগামী দিনে উপত্যকায় সন্ত্রাসবাদ আরও মাথাচাড়া দিতে পারে। কারণ, কাশ্মীরিরা চাপের মুখে মাথা নামিয়ে নেয়। কিন্তু পরে আবার মাথা তোলে। হাল ছাড়ে না। এটাই তাঁদের ইতিহাস।
আচ্ছে দিন-এর প্রবক্তা ভালোই জানেন আশাভঙ্গের সম্ভাবনা। যুবসমাজকে চাকরি ও জীবিকা নির্বাহের নতুন স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া যেতে পারে তখনই, যখন মোটের উপর একটি শান্তি ও স্থিতির আবহ তৈরি থাকে। অনুকূল পরিবেশ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নতির পরিবেশ তৈরি করা অসম্ভব। কে করবেন লগ্নি, কিংবা ব্যবসা, কিংবা চাকরি, যদি এক দিকে সেনাবাহিনীর চাপ ও অন্য দিকে উগ্রপন্থী হামলা অব্যাহত থাকে? কোনও অঞ্চলের যুবশক্তি আস্থা হারিয়ে ফেললে তাকে আর উন্নয়ন-কাজে ফিরিয়ে আনা সহজ নয়— কাশ্মীরে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি রূপায়ণ কোনও মতেই সহজ হবে না।
এ সবই মোদি জানেন। তবু তাঁকে রাজনীতির প্রয়োজনেই শূন্যগর্ভ ঘোষণা চালিয়ে যেতে হয়!