বিশেষ নিবন্ধ

ক্ষুধার্ত পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর খেলা
মৃণালকান্তি দাস

পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ কর্তা ‘ডার্টি হ্যারি’! আইএসআইয়ের এই কমান্ডারের কলকাঠিতেই নাকি ইমরানকে খুনের ছক কষা হচ্ছে। পাকিস্তানের অলি-গলিতে ঘুরছে এমনই খবর। ‘ব্রিগেডিয়ার’ ফয়জল নাসিরের নাম প্রকাশ্যে এনেছে তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-এর সমর্থকরাই। ইসলামাবাদ আদালত চত্বরে সেনার হাতে গ্রেপ্তারের আগে ইমরান খান চেঁচিয়ে বলেছিলেন, ‘কান খুলে শুনুন, একজন গোয়েন্দা কর্তার নাম উল্লেখ করেছি, যে আমাকে দু’বার হত্যার চেষ্টা করেছে।’ পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনীতির অবস্থা তুলে ধরে ওই আইএসআই অফিসার সহ তাঁর সঙ্গে জড়িতদের উদ্দেশে রীতিমতো হুঁশিয়ারির সুরে পিটিআই প্রধান বলেছিলেন, দেশে কয়েকজন দুর্নীতিবাজকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে শ্রীলঙ্কার থেকেও খারাপ অবস্থা হতে চলেছে পাকিস্তানের।
এই ফয়জল নাসিরের উত্থানেও রয়েছে রহস্য। একজন সাধারণ পাক সেনা অফিসার হঠাৎ করেই পাক গুপ্তচর সংস্থার শীর্ষ অফিসার পদে উঠে এসেছেন। নজর তো পড়বেই। পাক মিডিয়ার খবর, আইএসআইয়ের ডিরেক্টর জেনারেল লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আঞ্জুমের ডান হাত হিসেবে পরিচিত এই মেজর জেনারেল। অভিযোগ, ইমরান ও তাঁর সমর্থকদের চিরতরে সরাতেই পদোন্নতি দিয়ে আইএসআইয়ের মাথায় বসানো হয়েছে ফয়জলকে। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমগুলি জানাচ্ছে, নিয়ম অনুযায়ী, পাক সেনায় একসঙ্গে ১০ জনের বেশি ব্রিগেডিয়ারের পদোন্নতি হয় না। সেই নিয়ম ভেঙে কয়েকদিন আগে অন্তত ৩০ জন ব্রিগেডিয়ারের পদোন্নতিতে নির্দেশিকা জারি করে পাক সেনা। সেই তালিকায় ছিল ফয়জল নাসিরের নাম। সেনাবাহিনীর যুক্তি, ব্রিগেডিয়ার থাকাকালীন কোর অব মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের দায়িত্ব সামলেছিলেন ফয়জল। সেই কারণেই পদোন্নতি দিয়ে তাঁকে আইএসআইতে নিয়ে আসা হয়েছে।
সম্প্রতি ইমরানের উপর যে হামলা হয়েছিল তার পরিকল্পনাও নাকি ছিল ‘ডার্টি হ্যারি’-ই। শ্যুটার ঠিক করা থেকে শুরু করে অস্ত্র জোগানো— হামলার পুরো পরিকল্পনাই এই আইএসআই অফিসারের মস্তিষ্কপ্রসূত। এমনই খবর পাক সংবাদমাধ্যম ডন-এর। গত বছর ইমরান ঘনিষ্ঠ শাহবাজ গিলকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তাঁর উপর অত্যাচার করা হয়েছিল বলেও অভিযোগ ওঠে। ইমরান সেই সময় দাবি করেছিলেন, তাঁকে রাজনৈতিকভাবে পঙ্গু করতেই ওই পদক্ষেপ। সেই ঘটনার নেপথ্যেও মেজর জেনারেল ফয়জলের হাত ছিল বলে অভিযোগ তুলেছিলেন ইমরান। এখানেই শেষ নয়, আইএসআইয়ের ওই কমান্ডারের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা বিরাট। সম্প্রতি সাংবাদিক আরশাদ শরিফ খুনেও তাঁর নাম জড়িয়েছিল। আরশাদের মা রিফাত আলা আরভি পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়ালকে চিঠি লিখে সেই কথা জানিয়েছিলেন। আরশাদ শরিফ একদিকে ইমরানকে সমর্থন, অন্যদিকে পাক সেনার বিরুদ্ধে লাগাতার সমালোচনা করার কারণে আইএসআইয়ের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে কেনিয়ায় পালিয়েছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। পুলিসের রিপোর্ট অনুযায়ী, তাঁকে কেনিয়ায় গুলি করে খুন করা হয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ডেও নাম জড়িয়েছিল আইএসআই কর্তা ফয়জলের।
আসলে পাকিস্তানের অন্দরে রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সেনা কর্তাদেরই নাম। জন্মলগ্ন থেকেই সেনা জেনারেলদের হাতের পুতুল হয়ে রয়েছে পাকিস্তান। রাষ্ট্রটির ভিত্তি যিনি স্থাপন করেছিলেন, তিনি আদতে মহম্মদ আলি জিন্না নন, তিনি মেজর জেনারেল ইসকান্দর মির্জা। পাকিস্তান জন্মের এক বছরের মধ্যেই জিন্নার মৃত্যু হয় এবং ইসকান্দর মির্জাই হয়ে উঠেছিলেন প্রকৃত স্থপতি। মির্জা পাকিস্তানকে শুধু শাসনই করেননি, সেনা জেনারেলদের হাতে দিয়ে গিয়েছেন সীমাহীন ক্ষমতা। এই জেনারেলরাই চার দশকের বেশি সময় ধরে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে পাকিস্তানকে শাসন করেছেন। তাই গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকারের কেউই নিজেদের মেয়াদ পূরণ করতে পারেনি। পাকিস্তানের ইতিহাসে এক রাজা যান। অন্য রাজা আসেন। কখনও সেনা অভ্যুত্থান, কখনও বাধ্যতামূলক ইস্তফা, কখনও আদালতের রায়, কখনও গৃহবন্দি, কখনও বা খুন অথবা দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়ে মেয়াদ ফুরনোর আগেই চলে যেতে হয়েছে পাক প্রধানমন্ত্রীদের। একের পর এক। লিয়াকৎ আলি খান দিয়ে যার শুরু। ইমরান খানে এসে আপাতত শেষ। গোটা ইতিহাস পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাজানো এবং পূর্ব পরিকল্পনা মতোই একটার পর একটা ঘটনা ঘটে চলেছে। শীর্ষ পদগুলির অস্থিরতা, অস্থায়ী সরকারই যেন পাকিস্তানের ললাটলিখন!
গত সাত দশক ধরে যাকে ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’ বলে মনে করত ইসলামাবাদ, সেই আমেরিকা তার রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থেই এত দিন ইসলামাবাদের গণতন্ত্রকে গড়ে ও বেড়ে উঠতে দেয়নি। অস্ত্র বেচবে বলে পাক গণতন্ত্রের ‘বন্ধু’ হয়নি আমেরিকা। লাগাতার অস্থিরতা থাকলে, সন্ত্রাসের বাতাবরণ থাকলে, সংসদীয় গণতন্ত্রের উপর সেনাবাহিনীর মাতব্বরি বজায় থাকলে, অস্ত্র বেচতে সুবিধা হয়। অস্ত্রের বড় বাজার তৈরি হয়। পাকিস্তানের ঘাড়ে বন্দুক রেখে ভারতীয় উপমহাদেশে কর্তৃত্ব বজায় রাখাটা সহজতর হয়। তাই পাক গণতন্ত্রের ‘বন্ধু’ হতে পারেনি আমেরিকা। চায়ওনি। তাই পাকিস্তান বার বার অস্থায়ী সরকার দেখেছে। সেনা অভ্যুত্থানের শিকার হতে দেখেছে।
কেন পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ভিত স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও মজবুত হয়নি? বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাকিস্তানের জনক মহম্মদ আলি জিন্নার হঠাৎ মৃত্যু, তারপর আচমকা খুন হন প্রথম পাক প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলি খান। ওই দু’টি ঘটনাই পাকিস্তানের কপাল পুড়িয়েছে। অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে গণতন্ত্রের বীজ রোপণের সম্ভাবনা। সেই সময় জিন্নার দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল)-এর সামনের সারির প্রধান দুই নেতা ছিলেন খোজা নিজামুদ্দিন ও মৌলানা ভাসানি। তাঁদেরই মুখ হয়ে ওঠা উচিত ছিল পাক রাজনীতির। করা হয়নি, কারণ তাঁরা বাঙালি। বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, অথচ ২ শতাংশেরও কম মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন, সেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হয়েছিল। বাংলার জন্য শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলন। সেনাবাহিনী দিয়ে সেই আন্দোলনকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল। সেনাবাহিনী প্রধান প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠল পাকিস্তানে। নির্বাচন নেই। নির্বাচিত পার্লামেন্ট নেই। সেনাবাহিনীর হাতে রয়েছে অস্ত্র। তাই সেনাই হয়ে উঠল রাজনৈতিক ক্ষমতার চালিকাশক্তি। নিয়ন্ত্রকও। সেই শুরু...।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর অমিত বানসাল বলছেন, এই ঘটনা যে কারও পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন, পাকিস্তানের মতো দেশে সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে উত্তেজিত জনতা ঢুকে পড়তে পারে, একজন কোর কমান্ডারের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে এবং কোনও রকম বাধা ছাড়াই সামরিক বিমান ঘাঁটিতে ঢুকে তোলপাড় করতে পারে। এটাও বিশ্বাস করা শক্ত, পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী লোকগুলি যে ভবনের বাসিন্দা, সেখানে বিক্ষোভকারীদের প্রায় বিনা বাধায় ঢুকতে দেওয়া হয়েছে। আসলে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নিজেই পরিকল্পিতভাবে এসব বিক্ষোভ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছে। যাতে দেশে সামরিক আইন জারির একটা মোক্ষম অজুহাত দাঁড় করানো যায়। কে না জানে, ‘পৃথিবীর সব দেশের নিজের নিজের সেনাবাহিনী রয়েছে আর পাকিস্তানই একমাত্র দেশ, যেখানে সেনাবাহিনীর একটি দেশ আছে।’ এখানে সেনাবাহিনীই প্রকৃত শাসক। পাকিস্তানই একমাত্র দেশ, যেখানে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা সেনাবাহিনী ঠিক করে দেয় এবং নির্বাচন হয় ‘লোক দেখানো’। ইমরান খান যখন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তখনও অভিযোগ উঠেছিল, সেনাবাহিনী ভোটে কারচুপি করে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছে। আর যখন তাঁকে উৎখাত করা হয়, তখনও সেই সেনাবাহিনীর কলকাঠি নাড়ার বিষয়টি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার ছিল। গোটা দুনিয়া এও জানে, সেনাবাহিনীর অঙ্গুলিহেলন ছাড়া পাকিস্তান অগ্নিগর্ভ হওয়া সম্ভব নয়।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, পাকিস্তানি এস্টাবলিশমেন্ট (পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং আমলাতন্ত্র, রাজনীতি, বিচার বিভাগ ও শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকা সেনা সমর্থক গোষ্ঠীর শাসক চক্রকে বোঝাতে এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়) এবং ইমরান খানের সমর্থকদের মধ্যে লড়াইয়ে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছে। তাঁরা এও জানেন, সেই গৃহযুদ্ধে পাক সেনাবাহিনী যে কোনও আন্দোলন–বিক্ষোভ দমন করে ফেলতে সক্ষম। কিন্তু ইমরানকে বাদ দিয়ে কি পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব? প্রশ্নটা তুলেছেন ডন পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক আব্বাস নাসির। সেই প্রশ্নের উত্তর না মিললেও, অস্বীকার করার উপায় নেই পাকিস্তান দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। একদিকে ইমরান, অন্যদিকে সেনাবাহিনী। ক্ষুধার্ত পাকিস্তান জ্বলছে রাজনীতির আগুনে!
পাকিস্তানে নিরবচ্ছিন্ন হিংসায় উদ্বিগ্ন সাউথ ব্লকও। নিয়ন্ত্রণরেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্ত বরাবর সতর্কতা এবং প্রহরা আরও কড়া করার নির্দেশ দিয়েছে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলা শুরু করেছেন, পাকিস্তানের মতো একটি দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি হাতের বাইরে চলে যায়, তা গোটা উপমহাদেশকেই অস্থির করে তুলতে পারে। বাড়বাড়ন্ত হবে জঙ্গি গোষ্ঠীর। আম জনতার রোষ থেকে বাঁচতে ভারতের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে পাকবাহিনী। ভারত কি চাইবে সেই যুদ্ধে জড়াতে? তা ঠিক করবেন মোদি-অমিত শাহরাই। ভয় হয় এই ভেবে, ইতিমধ্যে ভারতেও লোকসভা ভোটের ক্ষণগণনা শুরু হয়ে গিয়েছে!
16Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

মৃৎশিল্পী, ব্যবসায়ী প্রমুখদের বিশেষ কর্মোন্নতি যোগ প্রবল। পেশাদারি কর্মে শুভ ফল প্রাপ্তি। মানসিক চাঞ্চল্য।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.০৯ টাকা৮৪.৮৩ টাকা
পাউন্ড১০৯.৪৭ টাকা১১৩.০৪ টাকা
ইউরো৯১.০৬ টাকা৯৪.২৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা