‘অপহরণ’ ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে পাকিস্তানের সাবেক কাপ্তান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে। খান সাহেবের গ্রেপ্তারিতে দুর্নীতির অভিযোগকে ঢাল করা হলেও আসল কলকাঠি নেড়েছে নাকি পাক সেনা। সহজ অনুমান এই যে, দিন যত গড়াবে তত বাড়বে পাক মুলুকে সেনার মাতব্বরি। সেখানকার রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর যেকোনও ধরনের বাহাদুরির চূড়ান্ত লক্ষ্য কাশ্মীর। পুরো কাশ্মীরকে ভারতের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার নিষ্ফলা হুঙ্কার চলবে কিছুদিন। পাল্টা জবাব দেওয়ার নামে, চুপসে যাওয়া ছাতি ফোলাবার ব্যগ্রতা বাড়বে দিল্লির বর্তমান শাসকের। হয়তো উশখুশ করবে দ্বিতীয় কারগিল বা দ্বিতীয় বালাকোট উপহার দেওয়ার জন্য। অতএব, সাধু সাবধান!
সময়টা খেয়াল করা দরকার। পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকার তৈরির ভোট কবে? তাদের বর্তমান জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৩ আগস্ট।
পাক সংবিধান অনুসারে, ভোটগ্রহণ শেষ করতে হবে ১৪ অক্টোবরের মধ্যে। পরবর্তী এপ্রিল-মে মাসের মধ্যেই হবে ভারতের লোকসভা নির্বাচন। অর্থাৎ যুযুধান দুই পড়শি রাষ্ট্রে সাধারণ নির্বাচনের মধ্যে ব্যবধান মাত্র ছ’মাসের। অপশক্তি সীমান্তের দু’পারেই তৈরিই থাকে বোধহয়। এ কি কোনও সেটিং কারবার? আমাদের পশ্চিম সীমান্ত তেতে উঠলেই এই স্বাভাবিক সন্দেহ জাগে। ভারতবাসীর চোখ এবার খুলে গিয়েছে। আশা করা যায়, বিজেপির এমন পাতা ফাঁদে তারা আর পা দেবে না।
কর্ণাটকে বিজেপির প্রচার ও লড়াইয়ের মধ্যে জয়ের আন্তরিক বাসনা ছিল কি? ভালোবাসা পেলে বনের হিংস্র পশুও তো পোষ মানে। সেখানে মানুষের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে মেরুকরণ, বিভাজন ও ঘৃণার রাজনীতির সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে বিজেপি। তাই প্রাপ্য পুরস্কারই বিজেপির, থুড়ি মোদি-শাহের হাতে উঠে এসেছে। বজরং দলের হিংস্র রূপ, হিজাব ও টিপু সুলতান ইস্যু, কোনও সংখ্যালঘু প্রার্থী না-দেওয়ার ধৃষ্টতার মাশুল গুনছে গেরুয়া শিবির। ২০১২, ২০১৭ ও ২০২২ সালের গুজরাত ভোটে কোনও মুসলিম প্রার্থী দেয়নি বিজেপি। অথচ ওই রাজ্যে জনসংখ্যার ৯.৭ শতাংশ মুসলিম। সংখ্যালঘুদের হিসেবের বাইরে বের করে দেওয়ার দুঃসাহসটা মোদির পার্টি সঞ্চয় করেছে গুজরাত থেকেই। ওই কৌশল প্রয়োগের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে তারা ২০২২ সালে ইউপিতে। সেবার ৪০৩টি আসনের একটিতেও মুসলিম প্রার্থী দেয়নি ‘অ্যালাউ’ করেননি যোগী আদিত্যনাথ। অথচ দেশের এই বৃহত্তম রাজ্যে জনসংখ্যার কমবেশি ২০ শতাংশ মুসলিম। কোনও সন্দেহ নেই, তাতেও বিপুল সাফল্য পেয়েছিল গেরুয়া রাজনীতি। আর যায় কোথায়, দাক্ষিণাত্যের মাটির চরিত্র আঁচ না-করেই বিজেপি ফের একই তাস খেলেছে কর্ণাটকে। শেষ আদমশুমারি অনুসারে, কর্ণাটকে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ১২.৯২ শতাংশ। সংখ্যাটি খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে ১.৮৭। বিধানসভার ২২৪টি আসনে কোনও মুসলিম ও খ্রিস্টান প্রার্থী দেয়নি বিজেপি।
নিজেকে বারবার এবং যত্রতত্র নকল করার রাজনীতি যে এতটা বিপজ্জনক হতে পারে, তার উপলব্ধি এবার হবে কি? কর্ণাটকে বিজেপির ৬৬ (-৩৮) আসনে জয়ের সামনে কংগ্রেসের ১৩৫ (+৫৫)—স্রেফ কেন্দ্রীয় শাসকের গালে বারো সিক্কার থাপ্পড়। কংগ্রেস একাই ১৩৫। জোট শরিক ‘সর্বোদয় কর্ণাটক পক্ষ’-এর দর্শন পুট্টানাইয়ার জয়ের পর সংখ্যাটি হয়েছে ১৩৬। আশ্বাস মিলেছে এক নির্দল বিধায়কেরও (লতা মল্লিকার্জুন)। আগামী কাল, বৃহস্পতিবার শপথ নেবেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী। সম্ভবত, সিদ্ধারামাইয়া। ২০১৩-১৮ সালে তিনিই ছিলেন। অর্থদপ্তরের দায়িত্বসহ উপমুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন ডি কে শিবকুমার। ১৯৮৯ সালের (১৭৮ আসন এবং ৪৩.৮ শতাংশ ভোট) পর কংগ্রেস বা অন্যকোনও দল কর্ণাটকে এত বড় জয় হাসিল করল। ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জিতেছেন ১০৫টি আসনের প্রার্থীরা। তাঁদের মধ্যে ৭০ জন কংগ্রেসের। কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে ৪.৯ শতাংশ। তার ফলে কংগ্রেসের ভোট শেয়ার ৩৮ শতাংশ থেকে ৪২.৯ শতাংশ হয়েছে।
বিজেপি সরকার দুর্নীতি রুখতে পারেনি। এই সরকারের কাছে সেই প্রত্যাশাও কারও ছিল না। কারণ বিদায়ী বিজেপি সরকারটাই তৈরি হয়েছিল সমস্ত নীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে। কংগ্রেস যতগুলি স্লোগানে বাজিমাত করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘৪০ শতাংশ সরকার, বিজেপি মানে ভ্রষ্টাচার’। কাকতালীয় হলেও সত্যি যে, এবার বিজেপির আসন কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ! ডাবল ইঞ্জিনের কোনও ফায়দা পায়নি জনগণ। স্থায়িত্ব দূর অস্ত, চরম অস্থিরতার আশঙ্কা নিয়েই পাঁচটা বছর কাটিয়েছে কর্ণাটকের মানুষ। দক্ষিণী এই রাজ্যে আবার ‘মোদির সরকার’ চেয়েছিল বিজেপি। তাই এই লজ্জার হারের দায় মোদি ছাড়া অন্য কারও উপর বর্তায় না। কারণ জিতলে প্রধানমন্ত্রীই তাঁর ফ্যান ক্লাবকে দিয়ে—মোদি ম্যাজিক, মোদি ঝড়, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায় ইত্যাদি বস্তাপচা আওয়াজ তোলাতেন।
বিজেপির ২৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বী মন্ত্রীর মধ্যে গোহারা হয়েছেন ১২ জন, হেরোদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম শিক্ষামন্ত্রী বি সি নাগেশ, যিনি হিজাব ব্যানের মহানায়ক। এই নির্বাচন হতাশ করেছে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সি টি রবিকেও। তাঁকে বলা হয় ‘পোস্টার চাইল্ড অফ অ্যাগ্রেসিভ হিন্দুত্ব ইডিয়োলজি’। দলের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী পদেরও সবচেয়ে জোরালো দাবিদার ছিলেন তিনি। চিকমাগালুর, নিজের শক্ত ঘাঁটিতেই ভোক্কালিকা নেতা হেরেছেন কংগ্রেসের এইচ ডি থাম্মাইয়ার কাছে। এই আসনটি ২০০৪ সাল থেকে চারবার দখলে রেখেছিল বিজেপি। ভোটারদের সঙ্গে গদ্দারির উচিত শিক্ষা পেয়েছেন দলবদলু দশজন (বিজেপির ৯ ও এনসিপির ১ জন)। ২০১৯-এ অপারেশন লোটাসের সময় মোট ১৭ জন বিধায়ক ( কংগ্রেস ১৪ এবং জেডিএস ৩) মোদির হাত ধরেন। তার ফলে ২০১৯-এ এইচ ডি কুমারস্বামীর কংগ্রেস-জেডিএস সরকারের পতন হয়। পিছনের দরজা দিয়ে কুর্সিতে গিয়ে বসে বিজেপি, বি এস ইয়েদুরাপ্পার নেতৃত্বে। ভোটের আগে, এমনকী পরেও বিজেপি কোনও জোট করে ক্ষমতায় এলে আপত্তি ছিল না। পরিবর্তে, অন্য দলের কয়েকজন বিধায়ককে বেইমানি করতে প্ররোচনা দিয়েছিল তারা।
ক্ষমতার সেই মধুভাণ্ডটি ছিল বড়ই পলকা। দু’বছর পেরতে না পেরতেই মুখ্যমন্ত্রী বদলাতে বাধ্য হয় রেজিমেন্টেড পার্টি। বাসবরাজ বোম্মাই বিজেপি সরকারের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী হয়েও বড্ড বেশি দুর্গন্ধ ছড়িয়ে ফেলেন। সব মিলিয়ে শিক্ষাটা অনেক বেশি হয়েছে বিজেপির। কর্ণাটকের মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছে মাত্র ১২.৯২ শতাংশ মুসলিম ও ১.৮৭ শতাংশ খ্রিস্টান ভোটারের হাতে কত জাদু জমা থাকতে পারে! সংখ্যালঘু প্রভাবিত ৬৫টি আসন নিঃসন্দেহে এক নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে। এগুলির অর্ধেকের বেশি তুলে নিয়েছে কংগ্রেস। কংগ্রেসের ১৫ জন মুসলিম প্রার্থীর মধ্যে জয়ী হয়েছেন ন’জন। অন্যদিকে, গুরুত্বপূর্ণ দল জেডিএসের ঝুলি এই প্রসঙ্গে এবার শূন্য। তাদের ২২ জন সংখ্যালঘু প্রার্থীর মধ্যে সকলেই হেরে গিয়েছেন। নেতৃত্বের দোলাচল মনোভাবের জন্য জেডিএস’কে ভরসা করতে পারেননি সংশ্লিষ্ট ভোটাররা।
ভোটে স্বস্তিদায়ক রেজাল্ট হওয়ার পরই রাহুল গান্ধী তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন, ‘বন্ধ হয়ে গেল ঘৃণার বাজার। কংগ্রেস খুলে দিয়েছে ভালোবাসার দোকান।’ অন্যদিকে, মোদির বিশেষ মিত্র ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের মন্তব্য গেরুয়া শিবিরের অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মোদির ‘ডাবল ইঞ্জিন’ তত্ত্ব সরাসরি খারিজ করে দিয়ে নবীনবাবু বলেছেন, ‘মানুষ রাজ্যের উন্নয়ন চায়। ভালো এবং জনমুখী প্রশাসনেরই জয় হয় সবসময়।’
অন্যদিকে, উত্তরপ্রদেশ পুরভোটে বিজেপির কিছুটা মুখরক্ষার মধ্যেও ভারতবাসীর জন্য সুখাবহ ইঙ্গিত রেখে গেল অযোধ্যা। সেখানে ৬০টি আসনের অর্ধেকও বিজেপি পায়নি, তাদের সংগ্রহ মাত্র ২৭। পুরভোট দেখিয়ে দিল, রামরাজ্যের স্বপ্নে চিড় ধরেছে রামভক্তদেরই মধ্যে। মুসলিম প্রার্থীদের জেতানোর জন্যও আজ তৈরি তাঁদের মন। রাম অভিরাম দাস ওয়ার্ডে মুসলিম ভোটার যৎসামান্য। সেখানেই জিতেছেন নির্দল প্রার্থী সুলতান আনসারি। বিজেপি এখানে সেকেন্ড বয়ও হতে পারেনি!
আমরা কারও মতো ‘মাঙ্কি বাত’ বলছি না। কিন্তু মোদির মন কি বাত-এর শ্রোতার সংখ্যা এরপর তলানিতেই যাবে। প্রচারে রাজসূয় যজ্ঞের খরচ করে এবং শ্রোতা হতে অনাগ্রহী তরুণ-তরুণীদের শাস্তি দিয়েও এই ক্ষয় আর রোধ করা যাবে না। যেকোনও ক্ষয় একবার শুরু হলে খুব কম ক্ষেত্রেই তা রোখা সম্ভব হয়েছে। যেমন পবিত্র গঙ্গার পাড়ের ভাঙন রুখতে পারেনি খোদ মোদি সরকার। বিজেপির গোলমেলে অস্ত্রগুলি ভোঁতা হয়ে আসছে একে একে। চব্বিশের ভোটের আগে, আশঙ্কা মতো, পাকিস্তানকে শায়েস্তা করার নামে যুদ্ধের জিগির তুললেও ব্যর্থ হবে সেই গেরুয়া অপকৌশল।