বিশেষ নিবন্ধ

জোট হলে চব্বিশে
মোদির নৌকা ডুবে যাবে
হিমাংশু সিংহ

৪৫ বছর আগের কথা। সাতাত্তরের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের একবছরের মধ্যেই কর্ণাটকের চিকমাগালুরে জিতে জাতীয় রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সালটা ছিল ১৯৭৮। প্রতিপক্ষকে নেহরু কন্যা হারিয়েছিলেন ৭৭ হাজারেরও বেশি ভোটে। সেখান থেকেই কার্যত নবজন্ম হয়েছিল কংগ্রেসের। সাড়ে চার দশক পর আবার কর্ণাটক। ফের প্রমাণ হল—গণতন্ত্রে কোনও দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা, সাম্প্রদায়িক বিষ, দেদার টাকা আর এজেন্সি শেষকথা বলে না, বলেন সাধারণ ভোটাররাই। হাজার হাজার রোড শো করলেও মানুষের অসন্তোষ ও প্রত্যাখ্যানকে জাদুবলে ঢেকে দেওয়ার ক্ষমতা নেই ছোট বড় কোনও নেতার। জরুরি অবস্থার জুজু দেখিয়ে ইন্দিরা গান্ধী দেশের মানুষের কণ্ঠরোধ করতে পারেননি। আবার এটাও সত্যি, সাতাত্তরের ভরাডুবি কাটিয়ে অনায়াসে ১৯৮০ সালেই কেন্দ্রে তাঁর নেতৃত্বেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কংগ্রেস সরকার। প্রমাণ হয়েছিল, কোনও দল কিংবা নেতার ক্ষমতা নেই গণতন্ত্রকে কুক্ষিগত করার। এখানেই ভারতীয় সংবিধানের অপার শক্তি।
তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। আজ নরেন্দ্র মোদি বিভাজনের বিষ ছড়িয়ে, বিরোধীদের দরজায় এজেন্সি পাঠিয়েও দেশটাকে কিছুতেই কব্জা করতে পারছেন না। হিমাচল গিয়েছে, কর্ণাটকও হাতছাড়া হল। মধ্যপ্রদেশ সহ একাধিক রাজ্যে  পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখলের হিসেবও মানুষ ঠিক সময় চুকিয়ে দেবে। রাজস্থানে বিদ্রোহ করে বসে আছেন স্বয়ং বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী বসুন্ধরা রাজে। উত্তরপ্রদেশে ঝুঁকির গন্ধ পেলেই আইনের নজর উপেক্ষা করে এনকাউন্টারে খতম করে দিচ্ছেন মহান যোগী। সবই উতরে যাচ্ছে দিল্লিতে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও গেরুয়া শিবিরের বিপদ কিন্তু ক্রমেই ঘনাচ্ছে। ইন্দিরার নির্দেশে অসমের নেতা দেবকান্ত বড়ুয়া স্লোগান তুলেছিলেন, ‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া!’ প্রায় পাঁচদশক আগে। মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন তামাম বিরোধী শক্তির। কংগ্রেসের সেই স্লোগান হালে পানি পায়নি। ভরাডুবি হয়েছিল। প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে দেশের প্রথম অকংগ্রেসি সরকারের। ওই ঘটনার পঞ্চাশ বছর পর সত্তর পেরনো এক গুজরাতি যুবকও সেই একই ভুল করে বসলেন। শততম ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিলেন তাঁর মনের কথা, ‘মোদি ইজ ইন্ডিয়া’। কর্ণাটকের ফল দেখাল, এবারও সংবিধান প্রণেতারাই জয়ী। গণতন্ত্র কারও আঁচলের খুঁটে বাধা থাকা সস্তা পণ্য নয়। ঠিক সময় পাশা উল্টে দেয় জনগণ। যেমন দাক্ষিণাত্য থেকে মুছে গেল বিজেপি। নরেন্দ্র মোদির ক্যারিশমা, সকাল বিকেল জনসভা, হরেক কিসিমের প্রকল্প ঘোষণা কোনও কাজেই এল না। মুখ থুবড়ে পড়ল সব।
সাফল্য একইসঙ্গে অনেক দায়িত্বও চাপিয়ে দেয়। লোকসভা ভোটের একবছর আগে নিশ্চিতভাবেই জাতীয় রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকের মুখে। এই পরিস্থিতিতে কর্ণাটকে দলীয় বিধায়কদের বেচাকেনা রুখে একটা সামগ্রিক মোদি বিরোধী জোট গড়াই কংগ্রেসের প্রথম ও শেষ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। এবং রাহুল গান্ধীদের তা করতে হবে ‘বড়দা’ সুলভ মনোভাব বিসর্জন দিয়ে। বুঝতে হবে এই জয় শুধু কংগ্রেসের একার জয় নয়, সমস্ত মোদি বিরোধী শক্তির জয়। সবাইকে এক হতে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফর্মুলা মেনেই। এটাই সময়ের দাবি। যদি এমাসেই পাটনার গান্ধী ময়দানে অধিকাংশ বিরোধী নেতা ও নেত্রীরা সমবেত হয়ে জোটের সলতে পাকানো শুরু করতে পারেন তাহলে চব্বিশের লড়াই গেরুয়া শক্তির কাছে খুব একটা সুখকর হবে না। এখন শুধু দরকার জয়প্রকাশের মতো একজন নেতা, যিনি সবাইকে বাঁধতে পারবেন জোটের মন্ত্রে।
ইংরাজিতে একটা কথা আছে ‘ল অব ডিমিনিশিং রিটার্ন’। একই অস্ত্র বারবার ব্যবহার করলে তার আর ধার থাকে না। ভোঁতা হতে বাধ্য। গত এক দশক ধরে কী বিধানসভা, আর কী লোকসভা, প্রচারের মুখ সেই একজনই। বস্তুত বহু ব্যবহারে ‘মোদি ম্যাজিক’ আজ ক্রমশ ফিকে। সব রসদ ও ক্ষমতা লাগিয়েও তাই দাক্ষিণাত্য বিজয় আটকে গেল বিজেপির। প্রমাণ হয়ে গেল, ভারতীয় গণতন্ত্রের ক্ষমতা কোনও ব্যক্তি ও তাঁর অনুচরবর্গের হাতে বেশিদিন ন্যস্ত থাকে না। বারবার একই অস্ত্র ব্যবহার করলে তার ধার কমতে বাধ্য। কয়েকমাস আগে হিমাচলে কংগ্রেস সরকারের প্রত্যাবর্তনে তা প্রমাণিত হয়েছিল। এবার কর্ণাটকও তা প্রমাণ করল।  
উত্তর ভারতে আগামী বছরের ভোটে একাধিক রাজ্যে দলের আসন কমতে পারে, এই আশঙ্কা থেকেই দক্ষিণে ঘন ঘন প্রচারে দেখা যাচ্ছিল মোদিজিকে। আসন্ন চব্বিশের মেগা ফাইনালে কেরল, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু ও তেলেঙ্গানাকে পাখির চোখ করেছিলেন তিনি। কারণ দক্ষিণে ১৩০টি লোকসভা আসন রয়েছে। সেই লক্ষ্যেই বারবার বার্তা দিতে চাইছেন সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ভোটারদের। কিন্তু কর্ণাটক হাতছাড়া হতেই তাঁর সেই প্রয়াসও মাঠে মারা গেল। দক্ষিণ থেকে গেরুয়া পতাকার এই পিছু হটার অর্থ বিজেপি আবার হিন্দি বলয়ের দল হিসেবেই ছোট্ট গণ্ডিতে গুটিয়ে গেল। পূর্বে বাংলা, বিহার, ওড়িশায় অনেক চেষ্টা করেও এখনও তেমন অগ্রগতি হয়নি। মণিপুরে বিজেপি ক্ষমতায়, কিন্তু রাজ্যটা জ্বলছে। মানুষ দেখছে ডাবল ইঞ্জিনের ধাপ্পা। পশ্চিমে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বইয়ে একটা আশ্চর্য রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে গেরুয়া দলেরই সৌজন্যে। শিবসেনা, এনসিপি সবাই ভয়ে কাঁটা। এই বুঝি দলটাই ভেঙে যায়, নতুবা দলের সুপ্রিমো ইডি, সিবিআইয়ের সৌজন্যে জেলে যেতে বাধ্য হন। এই আশঙ্কা পেয়ে বসেছে অন্যতম সিনিয়র নেতা শারদ পাওয়ারকেও। ভাবটা এমন, কষ্টিপাথরে ঘষা সততার প্রতিমূর্তি হয়ে বিরাজ করছেন একমাত্র বিজেপি নেতা ও তাঁদের বশংবদরা।
সম্প্রতি সবমিলিয়ে কর্ণাটকে ক্ষমতা ধরে রাখতে গেরুয়া দল ৯ হাজারের উপর র‌্যালি, প্রায় দেড় হাজার রোড শো করেছে। তার মধ্যে অন্তত ৫০টি জনসভা ও রোড শোতে হাজির আধুনিক বিজেপির প্রাণভোমরা ১১২ ইঞ্চি ছাতির সম্রাট নরেন্দ্র মোদি। আরও অন্তত এক ডজন সভায় গৌরবময় উপস্থিতি অমিত শাহের। সেইসঙ্গে যুযুধান দুই কংগ্রেস নেতা সিদ্ধারামাইয়া ও শিবকুমারের ঝগড়াকে কাজে লাগানোর সুযোগ। কিছুই কাজে এল না! এর বিপরীতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সবমিলিয়ে করেছে ১৭৩টি বড় সভা আর পঞ্চাশটির মতো রোড শো করতে পেরেছে। কোনও তুলনাতেই আসে না। এই একটিমাত্র হিসেব থেকেই পরিষ্কার কত লোকবল ও টাকা খেটেছে বিজেপির আবার কর্ণাটক দখলের খেলায়। অনেকটা একুশের পশ্চিমবঙ্গের মতো। তারপর কেন্দ্রে সরকারে থাকার সুযোগে কোটি কোটি টাকার ‘সওগাত’। কিন্তু ফল বেরতেই সব পরিকল্পনা ব্যর্থ। কংগ্রেস শুধু জেতেইনি, বিজেপির তুলনায় অন্তত ৬ থেকে ৭ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছে। আর যে বিজেপি নেতারা ভারত জোড়ো যাত্রাকে এতদিন উপহাস করেছেন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাই, কর্ণাটকেই সবচেয়ে বেশিদিন হেঁটেছেন রাহুল গান্ধী। মোট ২১ দিন। তাই উপহাস করা বন্ধ হোক।
জনসভায় দাঁড়িয়ে স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী ছুড়ে দিচ্ছেন জয় বজরংবলী স্লোগান। এটা ভাবা যায়! আমরা কেউ হনুমানজির বিপক্ষে নই। তাঁর মাহাত্ম্য ভক্ত হিন্দুরা জানে। কিন্তু দেশের সর্বাধিনায়ক যখন ভোটের ৭২ ঘণ্টা আগেও ওই স্লোগানেই ভরসা রাখেন তখন স্পষ্ট বার্তা যায়, এই ধর্ম ভক্তি, শ্রদ্ধা, সৌজন্য, সহাবস্থান ও সহমর্মিতার কথা বলে না। বরং প্রতিনিয়ত মেরুকরণের বীজ বপন করে। কিংবা একটা নিছক সিনেমা যখন নির্বাচনী প্রচারের অস্ত্র হয়। একবছর আগে দ্য কাশ্মীর ফাইলস দেখিয়ে হিন্দু ভোটকে সুসংহত করার চেষ্টা হয়েছিল। তারপরও হিমাচল গেরুয়া দলের হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। এবার দ্য কেরল স্টোরি। দুঃখটা এখানেই। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে একমুখে বিকাশ ও উন্নয়নের কথা বলব, আবার সাম্প্রদায়িকতার তাসও খেলব, দুটো একসঙ্গে হয় না। হয় না বলেই দক্ষিণের একমাত্র রাজ্য থেকেও মুছে যেতে বসেছে বিজেপি। 
তবে কি কর্ণাটক থেকেই মোদিজির বিগত আট বছরের স্বপ্নের দৌড়ের শেষের শুরু? এই প্রাসঙ্গিক প্রশ্নও উঠছে। নিঃসন্দেহে এই ঝোঁক অন্য রাজ্যে সংক্রামিত হলে বিজেপির সর্বনাশ। রেড্ডি ভাইদের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির জন্যই কর্ণাটকের মানুষ দীর্ঘদিন খাপ্পা ছিল। যে কোনও কাজে ৪০ শতাংশ কমিশন দিতে গিয়ে তাঁদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড়। তার উপর বিজেপির অতিমাত্রায় লিঙ্গায়েত নির্ভরতাও কাল হয়েছে। নেতৃত্বের প্রশ্নে দলে প্রকাশ্য বিরোধ তৈরি হলেও লিঙ্গায়েত ইয়েদুরাপ্পাকে একটি কথা বলারও সাহস হয়নি দিল্লির নেতাদের। 
কর্ণাটক একটা আগুনের ফুলকি মাত্র। আগামী কয়েকমাসের মধ্যে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা ও মিজোরামে নির্বাচন। তাই চব্বিশের মূল লড়াইয়ের আগে অনেক কঠিন ‘হার্ডল’ পার করতে হবে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহকে। সেই অগ্নিপরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফেরাই নয়, আটকে যাবে নেহরু-গান্ধীর কংগ্রেসকে মুছে দিয়ে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার এজেন্ডা। অযোধ্যার মন্দিরের সূচনার পর অভিন্ন দেওয়ানি বিধি রূপায়িত না-হলে স্বাধীনতার শতবর্ষে চা-ওয়ালার ব্যাটাকে ক’জন মনে রাখবে? অমৃতকালেই শেষ হয়ে যাবে তাঁর যাবতীয় কারিকুরি। ক্ষমতা ফুরোলে কে আর কাকে মনে রেখেছে। প্রশ্ন একটাই, শেষে ইতিহাস থেকে নেহরুকে মুছতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি নিজেই মুছে যাবেন না তো!
17Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

ধর্মকর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণে মানসিক তৃপ্তি ও সামাজিক সুনাম। পেশাদার শিল্পীদের শুভ সময়।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৮.২৫ টাকা১১১.৮০ টাকা
ইউরো৯০.৭১ টাকা৯৩.৮৮ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা