পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাসের আলোচনায় জানা যায় যে আমেরিকা, মিশর, গ্রীস, রোম, পশ্চিম এশিয়া এবং অন্যান্য দেশেও কোনও না কোনও প্রকারে নানা নামে দেবীপূজার প্রচলন ছিল। প্রাগৈতিহাসিক যুগ হইতে ভারতে শক্তিপূজা প্রচলনের বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। বৈদিক যুগ হইতে মহাশক্তি মহামায়ার উপাসনার প্রমাণ ও শক্তিবাদের আলোচনা দেবীসূক্ত, রাত্রিসূক্ত, গৃহ্যসূক্ত, নারায়ণ উপনিষদ্, যাজ্ঞিক উপনিষদ্, কেনোপনিষদ, ভুবনেশ্বরী সংহিতা, মহাভারত, বহু পুরাণ ও তন্ত্রে দৃষ্ট হয়। বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের বহু গ্রন্থে শক্তিপূজার কথা আছে। বহু গ্রন্থে নানা নামে শক্তিদেবতা অভিহিত হইয়াছেন। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে শক্তিদেবতার পূজার প্রচলন অপেক্ষা বঙ্গদেশে তান্ত্রিক ও পৌরাণিক দেবতার প্রতিমূর্তি নির্মাণ ও পুজোৎসবাদির সংখ্যা ও সমারোহ অনেক, অধিক। বিশেষতঃ শারদীয়া শ্রীশ্রীদুর্গাপূজার বৈশিষ্ট্য ও মহিমা এখনও পূর্ববৎ অত্যুজ্জ্বল রহিয়াছে। এই মহাপূজার একটি বিশেষ অঙ্গ দেবীর মাহাত্ম্য প্রকাশক গ্রন্থ যাহা মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত এবং ‘চণ্ডী’ নামে বিখ্যাত সেই ব্রহ্মময়ী মহাশক্তির লীলায় প্রদীপ্ত তন্ত্রসার মহাগ্রন্থের শ্রদ্ধা, ভক্তি ও একাগ্রতা সহ পঠন, শ্রবণ ও স্মরণ। মহাদেবী দুর্গার নামান্তর চণ্ডী বা চণ্ডিকা এবং তাঁহার মাহাত্ম্য প্রকাশ করে বলিয়া পুস্তকটির নামও ‘চণ্ডী’। এই গ্রন্থের অন্য দুইটি নাম সপ্তশতী ও মহাস্তোত্র। আরম্ভ হইতে অন্ত পর্যন্ত সর্বমোট মন্ত্রসংখ্যা সাত শত এই জন্যই সপ্তশতী নাম। তন্ত্রে এই সংখ্যা নির্ধারণ প্রসঙ্গে সমগ্র শ্লোক, শ্লোকার্ধ, মার্কণ্ডেয় উবাচ, দেব্যুবাচ প্রভৃতিকে এক একটি মন্ত্র ধরিয়া সর্বমোট সাতশত মন্ত্র স্থিরীকৃত হইয়াছে।
সাতশত মন্ত্রের প্রত্যেকটির শেষে স্বাহা বলিয়া যে হোম করা হয় তাহার নাম সপ্তশতী হোম। এই চণ্ডী বা সপ্তশতীর অন্য নাম ‘মহাস্তোত্র’, “যথাশ্বমেধঃ ক্রতুরাট্ দেবানাঞ্চ যথা হরিঃ। স্তবানামপি...এষ সপ্তশতীস্তবঃ।।” সকল যজ্ঞের মধ্যে অশ্বমেধ সর্বশ্রেষ্ঠ, ব্রহ্মের সত্ত্বগুণমূর্তি হওয়ায় অন্যান্য সকল দেবতার মধ্যে শ্রীহরি শ্রেষ্ঠ এবং সকল দেবদেবীর স্তবের মধ্যে মহামায়ার এই সপ্তশতীস্তব সর্বশ্রেষ্ঠ। সকল স্তবের মধ্যে পরম উৎকর্ষের জন্যই নাম মহাস্তোত্র। এই স্তোত্ররাজ পৌরাণিক হইলেও উপনিষদ্সার গীতার তুল্য সমাদর দিয়া সমগ্র ভারতের সর্বত্র সনাতনী হিন্দুগণ মাথায় রাখিয়া পাঠ ও শ্রবণ করেন। পরন্তু গীতা মোক্ষশাস্ত্র এবং জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, রাজযোগ ও কর্মযোগ প্রভৃতির দার্শনিক বিচারে সকলের পক্ষে সহজবোধ্য নহে। নিষ্কাম জ্ঞানী সন্ন্যাসীই গীতার্থবোধের প্রকৃত অধিকারী এবং শ্রাদ্ধবাসরে পরলোকগত আত্মার মঙ্গলের জন্য গীতার পাঠ হয়। কিন্তু মাতৃভক্তের গৃহে পুত্র জন্ম হইতে আরম্ভ করিয়া অন্যান্য সকল উৎসবে, যজ্ঞে ও অনুষ্ঠানে এবং জগন্মাতার পূজায় সকাম ও নিষ্কাম নির্বিশেষে চণ্ডী পঠন শ্রবণের
ব্যবস্থা অতি প্রাচীনকাল হইতে এখনও চলিয়াছে। চণ্ডী সকাম গৃহী এবং নিষ্কাম ত্যাগী সন্ন্যাসী উভয়কেই মহতী শিক্ষা দান করেন। স্বার্থান্ধ কর্মচারিগণের ষড়যন্ত্রে রাজ্যভ্রষ্ট সুরথ রাজা এবং স্বার্থপর পরিজনবর্গের দুর্ব্যবহারে দুঃখিত ও গৃহত্যাগী সমাধি বৈশ্য গহন বনে মিলিত হইয়া মেধসমুনির নিকট তাঁহাদের মনঃকষ্টের বিষয় ব্যক্ত করিলেন। তিনি তাঁহাদিগকে সাংসারিক মনুষ্যের দুর্গতির কারণ এবং সেই দুর্গতি হইতে রক্ষা পাইয়া পরম কল্যাণ লাভের উপায় বিষয়ে উপদেশ প্রসঙ্গে দেবতাবৃন্দ এবং জগতের মঙ্গলের জন্য ব্রহ্মশক্তি মহামায়ার অসুর বিনাশ প্রভৃতি লীলা এবং অনন্ত মহিমাদির কথা যাহা ব্যক্ত করিলেন তাহাই সপ্তশতীর প্রতিপাদ্য বিষয়। ঈশ্বরবিমুখ সংসারাসক্ত ব্যক্তিগণ মহামায়ার অবিদ্যাশক্তিতে আচ্ছন্ন থাকিয়া সংসারে সুখদুঃখ শোক, তাপ, ভোগ করে। কিন্তু যাঁহারা মহামায়ার শরণাগত হইয়া ভজন করেন তাঁর বিদ্যাশক্তি তাঁহাদিগকে সংসার-দুঃখ হইতে মুক্ত করিয়া শান্তি ও নির্মল আনন্দ দান করে।
পণ্ডিতপ্রবর জ্যোতির্ময় নন্দের ‘জ্যোতির্ময় রচনাঞ্জলি’থেকে