প্রশ্ন—মহারাজ, অনেকের বিশ্বাস ঠাকুরকে দেখলে আর ভাবনা নেই। রামবাবুরও (রামচন্দ্র দত্ত) সেই মত ছিল।
উত্তর—তাঁর কথা আলাদা, তাঁর তেমন ঠিক ঠিক বিশ্বাসও ছিল। শেষ পর্যন্ত সেই ভাব রেখে সব ছেড়ে দিলেন। অপরে শুধু মুখে বলে, কিন্তু ঠিক ঠিক বিশ্বাস নেই।
প্রশ্ন—মহারাজ, অনেকের বিশ্বাস—মাকে দেখেছি, সাধুসেবা করেছি, আমাদের আর ভাবনা কি?
উত্তর—মাকে দেখলে আর সাধুসেবা করলেই হয় না। ধ্যান-ধারণা বিবেক-বৈরাগ্য চাই।
রামলাল দাদা (ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র) আজ মঠে এসেছেন, ফিরে যাবার সময় মহারাজকে দু-একটা কথা জিজ্ঞাসা করলেন।
রামলাল দাদা—মহারাজ, তাহলে আমি কামারপুকুরে যাব, না শিবুকে পাঠাব?
উত্তর—কে জানে, দাদা, অপর কাউকে জিজ্ঞাসা কর। ওসব পরামর্শ-টরামর্শ এখন আমার আর আসে না। আমরা সাধুলোক, আমাদের ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’। চিরকাল জগৎটাকে মিথ্যা ভেবে ভেবে এখন ওসব বিষয়ে বড় একটা পরামর্শ দিতে পারি না, সব গুলিয়ে গেছে।
রামলাল দাদা—মহারাজ, আপনি যদি ওকথা বলেন তো আমরা যাই কোথা?
উত্তর—মন বড় খারাপ হয়ে গেছে, দাদা। এখন একলা থাকি ভাল। লোকজন আর ভাল লাগে না। এখন ইচ্ছে হয় কাশী-টাশী অঞ্চলে গিয়ে থাকি। যাদের সঙ্গে মনের খুব মিল ছিল তারা সব একে একে চলে যাচ্ছে। শশীর কাছে ওবার ছ-মাস ছিলুম, কি সুখেই দিন কেটেছে! ঠাকুরের ভাব শশীর মতো এমন আর কেউ নিতে পারেনি। দক্ষিণে বেড়াতে এক হাজার টাকা খরচ করলে। First class-এ (প্রথম শ্রেণীর গাড়িতে) বেড়ান, মুখে প্রতিবাদ করলুম, কিন্তু মনে মনে খুব খুশি হলুম। শশী টাকাকে পয়সার মতো জ্ঞান করত। সাধু এমনিই চাই। টাকাতে টাকা বোধ থাকবে না। এখন হরি মহারাজের কাছে থেকে সুখ হয়। তিনিও বাঁচবেন না, রোগে ধরেছে। ছেলেবেলা থেকে অটুট ব্রহ্মচর্য ছিল, healthও (স্বাস্থ্য) ভাল ছিল, তাই এখনো টেঁকে আছেন।
ঠাকুরের কাছে কি আনন্দেই ছিলুম! এখন ধ্যান-ধারণা করে যা না হয়, তখন তা আপনিই হতো। যদি মন কখনো একটু আধটু খারাপ হতো তিনি মুখ দেখেই টের পেতেন, আর বুকে হাত দিয়ে সব ঠিক করে দিতেন। তাঁর কাছে কত আবদারই না করতুম। একদিন তেল মাখাতে মাখাতে কি একটু বলেছিলেন, অমনি রেগে শিশি ফেলে দিয়ে হন্ হন্ করে চললুম। কিন্তু যদু মল্লিকের বাগানের কাছে গিয়ে আর যেতে পারলুম না—বসে পড়লুম। এদিকে ঠাকুর রামলাল দাদাকে পাঠিয়েছেন আমাকে ডাকতে। ফিরে আসতে বললেন, “দেখলি, যেতে পারলি? গণ্ডি দিয়ে রেখেছিলুম।”
স্বামী ব্রহ্মানন্দের ‘ধর্মপ্রসঙ্গে স্বামী ব্রহ্মানন্দ’ থেকে