ভগবান যখন মানুষ হয়ে আসেন, সেই রূপটি কেমন হয়, তার কিছু কিছু ছবি আমরা তাঁদের লীলা অনুধ্যানের ভিতর দিয়ে পাই। যেমন শ্রীরামকৃষ্ণলীলা বর্ণনা করেছেন তাঁরই লীলা পার্ষদরা। শ্রীভগবানের লীলায় তিনি রূপময়, গুণময়, প্রেমময় আনন্দময়। তিনি দিব্যসত্তা, তিনি স্বর্গীয় আনন্দ ও প্রেমের ঘনীভূত মূর্তি। কিন্তু ভগবানের আরেকটি সত্তা আছে। সেটি হল অরূপ অনন্ত সত্তা। ‘অনন্ত’! মানুষ কী করে ভাববে? মানুষ যে খুব ক্ষুদ্র, মানুষ যে খুব সীমিত। মানব সত্তার তিনটি স্তর আছে। প্রথম স্তর হচ্ছে জৈবিক, শারীরিক। দ্বিতীয় মন-বুদ্ধির স্তর। তৃতীয় স্তর আধ্যাত্মিক। মন-বুদ্ধির স্তরে নানা মাপের মানুষ আমরা আমাদের সমাজে দেখি। অনেক বড় বড় মানুষ দেখি, তাঁদের সম্পর্কে জানি। ইতিহাসে, পুরাণে বর্ণনায় অনেক বড় বড় মানুষের ছবি পাই। কিন্তু অনন্তকে কীভাবে দেখা যাবে বা পাওয়া যাবে? এর উত্তর খুঁজতে হবে মানবসত্তার তৃতীয় অর্থাৎ আধ্যাত্মিক স্তরে। মন ও বুদ্ধির পরিধি একটা সীমার রাজ্য পর্যন্ত। সীমার রাজ্য ছাড়িয়ে মানুষ কীভাবে অসীমে যাবে? সামর্থ্যের একটা সীমা আছে। যাঁরা সসীমের সীমা অতিক্রম করে আধ্যাত্মিকস্তরে উন্নীত হয়ে অনন্তকে অনুভব করেন, এমন সাধকরা আমাদের অনন্তের আভাস দেওয়ার চেষ্টা করেন। যেমন, একজন সাধক কবি—স্বামী প্রেমেশানন্দজী, শ্রীশ্রীমায়ের কৃপা ও আশীর্বাদপুষ্ট শিষ্য, তাঁর একটি গানে অসীমের রূপাভাস দিতে চেষ্টা করেছেন। যাঁরা গান রচনা করেন তাঁরা কবি, যাঁরা গান করেন তাঁরাও কবি। সাধক কবির গান দিব্য ভাব ও অনুভূতির স্পর্শ এনে দেয় শ্রোতার হৃদয়ে। একটি এমন গানের প্রথম দু-টি লাইন কতই না মাধুর্যপূর্ণ!
অরূপ সায়রে লীলা-লহরী উঠিল মৃদুল করুণাবায়
আদি অন্তহীন, অখণ্ডে বিলীন, মায়ার ধরিলে মানবকায়।
গানটির প্রথম এই দুটি চরণের মধ্যে কবি একটি বিশাল ভাবকে প্রকাশ করেছেন। তিনি, যিনি আদি অন্তহীন, করুণায় মানবকায়া ধারণ করেন। অনন্ত ভগবানের স্বেচ্ছাকৃত ক্ষুদ্ররূপ স্বীকার করা। যখন মানুষ সাধনায় তাঁর সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেন, তখন ভগবানের করুণা-মমতায় মানবকায় ধারণ করার গূঢ় রহস্য অনুভব করতে পারেন। কবি গানে ‘মায়ায়’ বললেন এজন্য যে, ভগবান রূপ-অরূপের লীলায় বাঁধা পড়েন না। মায়ার যথার্থ তাৎপর্য হল—যা তিনকালে সত্য নয়, এমন যা কিছু, তাকেই মায়া বলা হয়। জগতের সৃষ্ট বস্তু বিনাশী, তাই জগৎ তিনকালে সত্য নয়। জগৎ বিশাল, তবুও বড়ই ছোট। এই নীহারিকাতে অসংখ্য সৌরজগৎ আছে এবং তার মধ্যে অসংখ্য গ্রহ রয়েছে। কিন্তু সবই সীমিত। বৈজ্ঞানিকেরা দূরবীক্ষণ যন্ত্র লাগিয়ে অনেককাল থেকেই জগতের অনুসন্ধান করে চলেছেন, কিন্তু মহাকাশের শেষ সীমা নিরূপণ করতে পারেননি আজও। ধ্যানে মন মহাকাশ মহাবিশ্বকে ছাড়িয়ে রূপ-অরূপের সীমাবদ্ধতা লঙ্ঘন করতে সক্ষম। মনের অনন্তে লয় পাওয়াকে বেদান্তে নির্বিকল্প সমাধি বলে।
স্বামী বামনানন্দের ‘তোমাদের চৈতন্য হোক’ থেকে