এটা মনে করা একটা সাধারণ ভ্রান্তি যে বাসনা ছাড়া কাজ করা অসম্ভব, কিংবা, অন্ততপক্ষে, নিরর্থক। বলা হয়ে থাকে, বাসনাই যদি চলে যায় তবে কাজও থাকে না। কিন্তু এটাও অন্যটির মতো খুব ব্যাপক প্রচারমাত্র, খাঁটি মনের চেয়ে ভেদপ্রবণ এবং হিসেবী মনের কাছে এ ভাব বেশি আকর্ষণীয়। বিশ্বভুবনে যে কর্ম হয়ে চলেছে তার বেশিরভাগই সংসাধিত হচ্ছে বাসনা-কামনার হস্তক্ষেপ ছাড়াই; এর অগ্রগতি চলেছে প্রকৃতির প্রশান্ত প্রয়োজনে এবং স্বতস্ফূর্ত বিধানে। এমন-কি মানুষ অবিরাম নানা ধরনের কর্ম করে চলে স্বতোৎসারিত আবেগে, অন্তর্নিহিত ইচ্ছায় এবং বোধির প্রেরণায় অথবা সে কাজ করে স্বাভাবিক প্রয়োজনের আনুগত্যে এবং বিশ্বশক্তির বিধানে, মানসিক পরিকল্পনা এবং প্রাণের সচেতন প্রবেগ বা ভাবপ্রবণ বাসনা ব্যতিরেকে। প্রায়ই মানুষের কাজ তার ইচ্ছা অথবা তার কামনার উল্টো হয়; এ কর্ম তার ভিতর থেকে হয়ে চলে এক প্রয়োজনের তাগিদে অথবা অপ্রতিরোধ্য প্রবেগে, একটা আবেগের প্রতি আবিষ্ট হয়ে, তার মধ্যে এক শক্তির প্রতি আনুগত্যে যা ঠেলে নিয়ে চলে আত্ম-অভিব্যক্তির জন্য অথবা সচেতনভাবে এক উচ্চতর নীতিকে অনুসরণ করে।
বাসনা-কামনা হচ্ছে জুড়ে দেওয়া একটা আকর্ষণ যা মহাপ্রকৃতি অনেকাংশে দিয়ে রেখেছেন পাশবপ্রকৃতির জীবনে মধ্যবর্তী প্রয়োজনে এক ধরনের রাজসিক ক্রিয়া সৃষ্টির জন্য; এ-তাঁর একমাত্র, এমন-কি মুখ্য যন্ত্র নয়। এর মস্ত প্রয়োজন আছে যখন এ লেগে থাকে: তামসিকতা থেকে জেগে ওঠার জন্য এ আমাদের সাহায্য করে। এ-বস্তু অনেক তামসিক শক্তিকে অস্বীকার করে চলে, অন্যথায় তারা কাজই থামিয়ে দিতে পারত। কিন্তু সাধক, যে কর্মের পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে সে এই মধ্যবর্তী অবস্থাকে অতিক্রম করে গিয়েছে, যে-অবস্থায় বাসনা-কামনা হচ্ছে একটি সাহায্যকারী বাহক। তার কাজের জন্য এখন এর সহায় আর অবশ্যম্ভাবী নয়, বরং এটা কিন্তু ভয়ানক এক বাধা এবং পথের অন্তরায়, অসাফল্য ও ব্যর্থতার উৎস। অন্যেরা তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ এবং মতলব মতো চলতে বাধ্য হয়, কিন্তু তাকে নির্ব্যক্তিক অথবা বিশ্বপ্রসার মন নিয়ে কাজ করা শিখতে হবে অথবা সেই অনন্ত পুরুষের যন্ত্র কিংবা অংশরূপে। এক প্রশান্ত নির্লিপ্ততা, এক সানন্দ নিরপেক্ষতা অথবা এক আনন্দপূর্ণ সাড়া ভাগবতী শক্তির প্রতি, তিনি যা-ই নির্দেশ করুন। এ-ই হল শর্ত তার ফলপ্রদ কর্মের জন্য, তার গৃহীত মূল্যবান কোনো ক্রিয়া নিষ্পন্নের জন্য। বাসনা-কামনা নয়, আসক্তি নয় যা তাকে পরিচালিত করবে, কিন্তু এক ইচ্ছাশক্তি যা আলোড়ন সৃষ্টি করে ভাগবতী শান্তিতে, এমন-এক জ্ঞান যা উৎসারিত হয় তুরীয় জ্যোতি হতে, এমন-এক সানন্দ প্রবেগ যা তুরীয়ানন্দের দিব্যশক্তি।
তা হলে শ্রদ্ধাপূর্ণ কর্মের মাঝে ভগবানের প্রতি জীবনের মোড় ফেরানো সম্ভব কর্মে তার মনোভাবের দ্বারা। গীতায় যেমন বলা হয়েছে: ‘‘যে-ভক্ত ভক্তিভরে আমার প্রতি পত্র-পুষ্প, ফল ও জল অর্পণ করে আমি তা গ্রহণ করি এবং আস্বাদ করি।’’
শ্রীঅরবিন্দ ও শ্রীমায়ের বাণী সংকলন ‘কর্ম’ থেকে