‘দেখ ভগবানের এমন বিধান যে তাঁর রাজত্বে কেউ পাপ বেশী কর্তে পার্বে না। তার একটা সীমা আছে। তার বেশী করতে গেলে কোন-না-কোন প্রতিকূল অবস্থা এসে পড়্বেই। হয় সে মর্বে, না হয় স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে গিয়ে পাপ হ’তে বিরত হবে। কিন্তু পুণ্যের সীমা নাই। যত কর্তে পার। তেমনি আবার দুঃখেরও একটা সীমা আছে কিন্তু সুখের সীমা নাই, কান্নারও সীমা আছে কিন্তু হাসির সীমা নাই। সেজন্য হাস্তে হাস্তে মানুষ মারাও যায়।...
“এক সাধু ছিলেন, এককালে তাঁর তিনটা অবস্থা হ’ত—হাসি, কান্না, রাগ। যখন সে হাস্ছে, তখন তাঁর মুখ বেয়ে থপ্ থপ্ করে লাল গড়িয়ে পড়্ছে, কান্নার সময় এমন আকুল হয়ে কাঁদছে যেন তাঁর পুত্রশোক হয়েছে। আবার রাগ করবার সময় এমন এক একবার রেগে উঠ্ছে যে, মার তো মার—উপরের দিকে লাঠি তুলে মাটীতে মার্ছে। আমারও এক এক সময় এমন রাগ হ’ত! একবার ঐ মেদিনীপুরের জঙ্গলে ঘুর্ছিলান, তখন ব্রহ্মচারী বেশ, রাস্তায় যেতে যেতে সাম্নে এক খাই, জল এক হাঁটু, তাতে আমি রেগে ডুবে পড়্লাম, পরে কি ভাব হ’ল উঠে এলাম, সে অবস্থার কথা বলতে পারি না। তার পর যখন গৌরীমার কাছ থেকে ফিরে এসে গৌহাটি থাকি, তখন ঐ তিনটা অবস্থা যুগপৎ হ’ত। যখন হাস্তাম, তখন হাস্তে হাস্তে কাশী হ’ত, এদিক-ওদিক লাফিয়ে নেচে কাঁপিয়ে তুল্তাম। ওরা আমায় পরে এ-সব বলেছিল। ঐ সময়ের দেহের অবস্থার কথা বলা যায় না, সর্ব্বদা কাপড়ে বাহ্যি-পেচ্ছাব হয়ে যেত ঐ হাসির চোটে! যজ্ঞেশ্বরের বউটা সব ধু’ত। আপন ছেলের মত ক’রে কাপড় টেনে নিয়ে আর একখানা কাপড় পরিয়ে দিত। এখন সে সব কথা ভেবে আশ্চর্য্য হয়ে যাই!......ছোট ছেলেগুলোর মুখের হাসি কিন্তু দেখ্তে খুব ভাল। গল্ গল্ খল্ খল্ ক’রে হাসছে। কী প্রাণখোলা হাসি! আবার যখন কাঁদবে, তখন এমন আকুল হয়ে কাঁদবে যে অপরের মন-প্রাণ দয়ায় গলে যায়। রাগের সময় কিন্তু বেশ। এই এখুনি ভীষণ রাগ করেছে এক জনের উপর, তার সঙ্গে কখনও মিশবে না বা কথা কইবে না, আবার পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই বলছে—‘আয় ভাই, দু’জনে মিলে খেলা করি।’ এমনি। ছেলেদের ভাবগুলি কি মধুর! সাধুদের অবস্থা এইজন্য বালকবৎ হ’লে চরম হয়ে যায়।”
খুব শীত পড়েছে। আরতি-কীর্তনের পর ঠাকুর আসন-বারান্দায় এসে বস্লেন!...
ভুবনদা বললেন—“ঠাকুর, মোজাটা আন্ব কি, পায়ে দেবেন?” ঠাকুর বললেন—“না পর্ব না।”
প্রজ্ঞানন্দ মহারাজ বললেন—“পরুন ঠাকুর, বড় শীত পড়েছে আজ।”
ঠাকুর বল্লেন—“না পর্ব না। আমার সেবকরা খালি গায়ে আছে, তাদের জামা নাই, আর আমি জামা গায়ে দি, মোজা পরি, না তা হবে না।”
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ঠাকুর বল্তে লাগ্লেন—“শীতকালে এখানকার জলবায়ু খুব ভাল, এজন্য স্বাস্থ্যও খুব ভাল। সব আশ্রমের চেয়ে মঠের স্বাস্থ্য পছন্দই। পূর্ব্বে বর্ষাকালটায় খুব জ্বর-জারি হ’ত, এমনকি এক কড়া ক’রে সাগু পাক ক’রে দিতে হ’ত। দু’এক জন ছাড়া সকলে জ্বরে পড়্ত। এখন প্রায় সেরূপ হয় না। তাই বলছি মঠের স্বাস্থ্য এখন খুব ভাল হয়েছে।”
এমন সময় শরৎদা বল্লেন—“তবে ঠাকুর, শীতকালে খুব ক্ষিধে পায়।”
ঠাকুর হেসে বল্লেন—“গরীবের ঘরে ক্ষিদে কম পাওয়া ভাল। একবার ছোটনাগপুরে বেড়াতে গেছলাম, সাঁওতালদের জিজ্ঞেস করলাম—‘এখানকার জলবায়ু কেমন?’ তারা বললে—‘ভাল বটে, তবে খুব খিদে পাওয়ায়।’ ...খেতে পায় না, জলবায়ু ভাল হ’লে কি হবে?
“আসামের মধ্যে কোকিলামুখ একটা Sanitarium, এখানে অনেকে বায়ু পরিবর্তনের জন্য আসে। আমার কিন্তু আসামে আসার উদ্দেশ্য অন্য রকম ছিল। তখন ঢাকায় থাকতাম। লোকে দেখা করতে আস্ত। সেবকদের জিজ্ঞেস কর্ত—‘ঠাকুর কোথায় আছেন?’ ওরা বল্ত—‘এই আসছেন।’
স্বামী সত্যানন্দ সরস্বতী সম্পাদিত ‘শ্রীশ্রীনিগমানন্দের জীবনী ও বাণী’ থেকে